বুধবার (২ জানুয়ারি) ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গের সামনে বসে এভাবেই আহাজারি করছিলেন রাজধানীর মালিবাগে সুপ্রভাত পরিবহনের বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় নিহত মিম আক্তারের (১৩) মা জরিনা বেগম। মঙ্গলবার (১ জানুয়ারি) দুপুরে মালিবাগের ডিআইটি সড়কে ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝরেছে নাহিদা পারভীন পলিরও (১৯)।
মগবাজারের পূর্ব নয়াটোলার ভাড়াটিয়া পলি মালিবাগের এমএইচ পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। তার সঙ্গে মঙ্গলবার কারখানায় ঘুরতে এসেছিলেন পড়শী মিম।
জরিনা আহাজারি করতে করতেই বলেন, ‘পলির সঙ্গে গার্মেন্টস দেখতে গেছিলো আমার মিম। সে কইছিল, মিম তুই চাকরি করবি? এই কথা বইলা সঙ্গে নিয়া গেছিলো। একসাথে থাকতে থাকতে খাতির হয়া গেছে, তাই নিয়া গেছে। তারপর গার্মেন্টস থেকে পলির সাথে বাসায় ফেরার সময় দুর্ঘটনায় দুইজনে মইরা গেলো। ’
পলি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার মৃত ইজাজ আহম্মেদের মেয়ে। আর মিমদের বাড়ি বগুড়ার গাবতলীর উপজেলায়। তার বাবার নাম সোনাই মিয়া।
মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে গাবতলীর সাঘাইট্টা গ্রাম থেকে ঢাকায় ছুটে আসেন জরিনা বেগম। ঢাকায় এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের স্ট্রেচারে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পান তার কলিজার টুকরো মেয়েকে। একসময় পুরো ঘর মাতিয়ে রাখা মেয়ে এভাবে নিথর-নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে, দেখে যেন কান্নার বাঁধ ভেঙে গেলো জরিনার।
‘মাগো, ও মা, আমার মার মুখ কত সুন্দর আছিলো, আমার মার ছবি দেখরে। আমার মায়েরে কিয়ের লিগা ঢাকায় আনলাম। ও আল্লাহ তুমি আমারে ক্যান নিয়া গ্যালা না, মিমরে ক্যান নিয়া গেলা। ’
কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন জরিনা। আবার কেঁদে উঠছিলেন। গ্রাম থেকে ঢাকার গাড়িতে ওঠার পর টানা আহাজারি করতে করতে খাওয়া-দাওয়াও ভুলে গেছেন তিনি। তাকে স্বজনরা খাওয়ানোর চেষ্টা করলেও জরিনা ধরা গলায়ই বলতে থাকেন, ‘আমার ক্ষিধা নাই, আমার কলিজার টুকরা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। আর তোরা আমাকে খাইতে কস!’
মিমের বাবা দিনমজুর। দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোট মিম। তার বড়ভাই সুমনও দিনমজুর। বসতবাড়ি ছাড়া চাষাবাদের কোনো জমি নেই তাদের। আয় বলতে বাবা ও বড়ভাইয়ের প্রতিদিনের মজুরির টাকাই। এতেই চলতো তাদের সংসার।
ঢামেকে মিমের খালাতো ভাই সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, গতমাসের প্রথম দিকে মিমের মামাতো ভাই সানুয়ার বিয়ে করেন। তখন আমরা ঢাকা থেকে তাদের বাড়ি বগুড়ার গাবতলী যাই। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে গত ১৮ তারিখ মিমও আমাদের সঙ্গে ঢাকায় আমাদের বাসায় বেড়াতে আস। এরপর থেকে পূর্ব নয়াটোলায় আমাদের বাসায়ই ছিল মিম। এসময় তার পরিচয় হয় আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া নাহিদা পারভীন পলির সঙ্গে। কয়েকদিনেই দু’জন খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। এরপর পলির সঙ্গে তার গার্মেন্টসে যেতে আগ্রহ দেখায় মিম। আর মঙ্গলবার প্রথম দিনেই গার্মেন্টস থেকে বাসায় ফিরে দুপুরে খাবার খেয়ে আবার যাওয়ার সময় বাসের চাপায় মারা যায় সে।
এদিকে, বুধবার সকালে ঢামেক হাসপাতালের মর্গে মিম ও পলির মরদেহের ময়না-তদন্ত সম্পন্ন হয়। দু’টি মরদেহেরই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন হাতিরঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ফারুক খান। সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, মালিবাগ আবুল হোটেলের সামনে রাস্তা পার হওয়ার সময় সুপ্রভাত পরিবহনের বেপরোয়া বাস মিম ও পলিকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই মিম এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর পলির মৃত্যু হয়।
মরদেহের ময়না-তদন্ত শেষে দুপুরে মিমের মরদেহ নিয়ে যান তার স্বজনরা। তারা জানান, গ্রামে নিয়ে সেখানেই এই কিশোরীর মরদেহ দাফন করা হবে।
পলির কোনো স্বজন না থাকায় তার মরদেহ হাসপাতালের মর্গের ফ্রিজে রাখা হয়।
হাতিরঝিলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু মো. ফজলুল করিম বাংলানিউজকে জানান, দুর্ঘটনায় নিহত মিমের মা জরিনা বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। ওই বাসের চালক জুনায়েদকে (২৭) গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৯
এজেডএস/এইচএ/
** মালিবাগে শ্রমিক বিক্ষোভ: বাসে অগ্নিসংযোগ