দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে মেট্রোরেলের কাজ। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উড়ালপথ এবং স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে চলতি বছরের (২০১৯ সাল) ৩০ ডিসেম্বর।
উত্তরা থেকে আগারগাঁও এলাকা পর্যন্ত সারিবদ্ধভাবে দৃশ্যমান হয়েছে সুউচ্চ মেট্রোরেল পিলার। আর এসব পিলারের উপরে বসছে স্বপ্নের স্প্যান। এ স্প্যানের উপরে বসবে ব্যালাস্টলেস মেট্রোরেল ট্র্যাক। ট্র্যাকে থাকবেনা পাথর ও কাঠের স্লিপার। কংক্রিটের স্প্যানের উপরে বসবে মেট্রোরেল ট্র্যাক।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আগারগাঁও থেকে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত সমস্ত পিলার শতভাগ নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এসব পিলারের উপরে বসছে স্প্যান। স্প্যানগুলো উত্তরা দিয়াবাড়ি এলাকায় অবস্থিত মেট্রোরেল ডিপোতে নির্মিত। শেওড়াপাড়ায় ৮টি পিলারের উপরে বসেছে স্প্যান। এক পিলার থেকে অন্য পিলার পর্যন্ত মোট ১২টি ছোট ছোট স্প্যান স্লাইচ ব্যবহার করা হচ্ছে। মেট্রো রেলের প্রতিটি পিলারের ব্যাস দুই মিটার, ভূগর্ভস্থ অংশের ভিত্তি তিন মিটার। অন্যদিকে মাটি থেকে পিলারের উচ্চতা ১৩ মিটার। একটি স্তম্ভ থেকে আরেকটির দূরত্ব ৩০ থেকে ৪০ মিটার। এক পিলার থেকে অন্য পিলারে বসছে স্প্যান।
মাথার উপরে মেট্রোরেল স্প্যান স্থাপনে স্থানীয়দের মধ্যে দেখা দিয়েছে স্বস্তি। দ্রুতই ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া আশা করছে তারা। মিরপুর শেওড়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা নাজমুল হাসান। বসবাস করেন শাপলা সরণিতে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই উত্তরায় অফিসের উদ্দেশে যাত্রা করতে হয় নাজমুলের। মেট্রোরেল নির্মাণের কারণে প্রতিদিন সকালে জটলার পাশাপাশি ধূলাবালি মেখে অফিসে যেতে হয় তাকে। তবে মেট্রোরেলের স্প্যান বসানো দেখে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন নাজমুল। নাজমুল বলেন, অফিস যাওয়ার আগে সকালে সাধারণত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সবার সঙ্গে নিতে হয়। কিন্তু আমাদের সবার আগে নিতে হয় মাস্ক। ধূলাবালিতে শ্বাসকষ্টও হয়ে গেছে। সকালে শেওড়াপাড়া থেকে জ্যাম ঠেলে অফিসে যেতে হয়। তবে পিলার হয়ে যাওয়ার পর সেই ধূলাবালি কিছুটা কমেছে। এখন দেখে বোঝা যাচ্ছে মেট্রোরেল দ্রুত সময়েই হবে, আমাদের দুর্ভোগও কমবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, শেওড়াপাড়া থেকে আগারগাঁও পরিকল্পনা কমিশনের দ্বিতীয় গেট পর্যন্ত পিলার নির্মাণ কাজ শেষ। এখন শুধু স্প্যান বসানো হবে। যেখানে পিলার নির্মাণ গ্যাপ রয়েছে সেখানে স্টেশন নির্মাণ পরিকল্পনার জন্যই রাখা হয়েছে।
শেওড়াপাড়া থেকে মিরপুর-১০ নম্বরে অধিকাংশ স্থানে পিলার নির্মাণ কাজ শেষের পথে। মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরের পাশেই নির্মিত হচ্ছে মেট্রোরেল স্টেশন। মেট্রো রেলের চূড়ান্ত রুট অ্যালাইনমেন্ট হলো- উত্তরা তৃতীয় ধাপ-পল্লবী, রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে (চন্দ্রিমা উদ্যান-সংসদ ভবন) খামারবাড়ী হয়ে ফার্মগেট-সোনারগাঁও হোটেল-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত। এ রুটের ১৬টি স্টেশন হচ্ছে- উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, আইএমটি, মিরপুর সেকশন-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম ও বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত নয়টি স্টেশন নির্মিত হবে। তিনটি থাকবে উত্তরায়, দুটি মিরপুরে ও পল্লবী, কাজীপাড়া, শ্যাওড়াপাড়া ও আগারগাঁওয়ে একটি করে স্টেশন হবে।
স্টেশন নির্মাণের স্থানগুলোতে এখন দুর্ভোগ বেশি। পুরো সড়ক জুড়েই চলছে খোঁড়াখুড়ি। মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় স্টেশন নির্মাণ স্থান থেকে অরজিনাল-১০ এলাকায় কিছু অংশ গ্যাপ দিয়েই দেখা গেছে মেট্রোরেল প্রকল্পের সারিবদ্ধ পিলার। অরজিনাল-১০ থেকে মিরপুর-১২ নম্বর বিআরটিসি ডিপো পর্যন্তই কর্মযজ্ঞ চোখে পড়ার মতো। মিরপুর-১১ নম্বরে ছয়টি পিলারের উপরে বসেছে স্প্যান।
অন্যদিকে দিয়াবাড়ি এলাকায়ও পিলারের উপরে আগেই স্প্যান বসেছে। আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত যেতে শেওড়াপাড়া, মিরপুর ১১ ও দিয়াবাড়ি এলাকায় মেট্রোরেল স্প্যান এখন মাথার উপরে দৃশ্যমান হয়েছে প্রায় দুই কিলোমিটার সড়কজুড়ে। সঙ্গে সারিবদ্ধ চোখ জোড়ানো পিলারের সারিতো আছেই।
স্টেশন নির্মাণের জন্যই মূলত কিছু কিছু স্থানে পিলারের গ্যাপ দেখা গেছে। এসব স্থানে দুই পাশে যাতায়াতের সড়ক করে দেয়া হবে, পরবর্তীতে সড়কের মাঝ বরাবর পিলারসহ স্টেশন নির্মাণে আনুষঙ্গিক কাজ শুরু হবে। ইতোমধেই স্টেশন নির্মাণে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ত) আবদুল বাকি মিয়া বাংলানউজকে বলেন, দ্রুত গতিতে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু দিন নয় রাতেও চলছে স্প্যান বসানোর কাজ। উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁওয়ের দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। এরমধ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার সড়ক জুড়ে স্প্যান বসানো হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই আগারগাঁও থেকে পরিকল্পনা কমিশনের দ্বিতীয় গেট পর্যন্ত স্প্যান বসিয়ে ফেলবো।
কয়েকস্থানে পিলারের গ্যাপ প্রসঙ্গে প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী বলেন, এটা আমাদের টেকনিক্যাল কারণে। স্টেশন নির্মাণের স্থানে আগে দুই পাশে যাতায়াত ব্যবস্থা করবো তার পরেই সড়কের মিডলে কাজ শুরু হবে। সামনে যতো দিন যাবে ততোই মেট্রোরেল প্রকল্পের দৃশ্যমান কাজ চোখে পড়বে।
মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎ নেওয়া হবে জাতীয় গ্রিড থেকে। ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩ দশমিক ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর জন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁ ও বাংলা একাডেমি এলাকায় পাঁচটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থাকবে।
ঢাকার যানজট নিরসন ও নগরবাসীর যাতায়াত আরামদায়ক, দ্রুততর ও নির্বিঘ্ন করতে ২০১২ সালে গৃহীত হয় মেট্রোরেল প্রকল্প। এ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য হবে উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত, ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার। অর্থাৎ এ এলাকায় বসবাসকারী লাখো নগরবাসী মেট্রোরেল ব্যবহার করে গন্তব্যে যাতায়াত করতে পারবেন দ্রুত। এ প্রকল্পে ২৪ সেট ট্রেন চলাচল করবে। প্রত্যেকটি ট্রেনে থাকবে ৬টি করে কার। ঘণ্টায় ১শ কিলোমিটার বেগে ছুটবে যাত্রী নিয়ে। উভয়দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন বহনে সক্ষমতা থাকবে মেট্রোরেলের। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা
চলতি বছরেই খুলে যাবে প্যাকেজ-০৩ ও ০৪ । এর আওতায় উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৯টি স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। উভয় প্যাকেজের কাজ ২০১৭ সালের ১ আগস্ট শুরু হয়েছে। সংশোধিত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। ফলে চলতি বছরেই স্বপ্নের মেট্রোরেলে চড়বে ঢাকাবাসী।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৯
এমআইএস/এসএইচ