ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রাজা-রানি রঙে মননে-প্রেমে আবাহন

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯
রাজা-রানি রঙে মননে-প্রেমে আবাহন চারুকলায় বসন্ত উৎসবে নৃত্য পরিবেশন করছেন শিল্পীরা। ছবি-শাকিল আহমেদ

ঢাকা: প্রতিদিনের মতো আজও ভোর হয়েছে, সূর্য উঠেছে। তবে আজ ভোরের বাতাসে শীতের তীব্রতা নেই। নেই কুয়াশার ধূসর আচ্ছাদন। বরং সে বাতাসের স্নিগ্ধতা কোমল পরশে জানান দিচ্ছে আজ বসন্ত। তাইতো দূর দিগন্ত থেকে ভেসে আসে কোকিলের কুহুকুহু কলতান।

বকুলের পাতার নিচে দোয়েল যখন আলতো সুরে শীষ দিয়ে যায়, তখনও কোকিলের কলতানে মুখর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণে লেগে আছে শীত শেষের ঘ্রাণ। তার মধ্যেই ভোরবেলা বাসন্তী রাঙা বসন আর ফুলের শোভায় সেজে তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষ ছুটছে উৎসবের আঙ্গিনায়।

ফাল্গুনের প্রথম দিনে বসন্তের দোলা তাদের হৃদয়ে।

বুধবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) ফাগুনের প্রথম প্রহরে ষড়ঋতুর শেষ ঋতুটিকে বরণ করে নিতে কতো আয়োজন, কতো রঙ! হাজারো প্রাণের কল্লোলে নগর এখন সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির জয়গানে মুখর। সে মুখরতায় রাজধানীতে জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদ প্রতি বছরের মতো এবারও চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় করেছে বসন্ত আয়োজন। সে আয়োজনে ঋদ্ধতায় নিজেদের সব থেকে প্রিয় ঋতুটিকে বরণ করলো নগরবাসী।

সকাল ৬টা ৫৫ মিনিটে বেঙ্গল পরম্পরার যন্ত্রসহযোগে ধ্রুপদী সংগীতের মুর্চ্ছনায় শুরু হয় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। এরপরই আবৃত্তি শিল্পী ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়ের ‘বসন্তের আবাহন’ এবং আহকাম উল্লাহর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ পরিবেশনায় ভোরের উৎসব পায় অন্য মাত্রা। এরপর তাতে নান্দনিকতা যোগ করে লাইসা আহমেদ লিসার রবীন্দ্র সংগীত, মিতা হকের সুরতীর্থ বসন্তের গান, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি এবং প্রিয়াংকা গোপের নজরুল গীতি।

আয়োজনে ‘ভাবনা দোলা লাগিল আজি দক্ষিণ পবনে’ গানের সঙ্গে পরিবেশিত হয় সম্মেলক নৃত্য। পরিচালনা করেন নৃত্যশিল্পী প্রেমা। এরপর সমবেত সত্যেন সেনের পক্ষ থেকে সমবেত সংগীতে পরিবেশিত হয় ‘বিহুর লগন’ গানটি। নৃত্য সংগঠন নৃত্যমের পক্ষ থেকে নজরুল গীতির সঙ্গে পরিবেশিত হয় দলীয় নৃত্য। সমবেত ফোক ‘বসন্ত বাতাসে সই গো’ পরিবেশন করে বহ্নিশিখা। বিমান চন্দ্র বিশ্বাস পরিবেশন করেন লোকসঙ্গীত ‘তোমার কুঞ্জ সাজাও গো’।

এছাড়া পূজা সেনগুপ্তের পরিচালনায় ‘মাদল বাজে, বাজে বাঁশের বাঁশি’ গানের সঙ্গে আদিবাসী নৃত্য পরিবশেন করে তুরঙ্গম নৃত্য সংগঠন। ‘আজ বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশিত হয় নায়লা হাসানের পরিচালনায়। আর স্পন্দন পরিবশেন করে ‘ফাগুনেরও মোহনায়’ গানের সঙ্গে নৃত্য।

আয়োজনে অংশ নেয় রেওয়াজ পারফরর্মিং আর্ট (উচ্চাঙ্গ সংগীত), ভাবনা, নটরাজ, নৃত্যনন্দন, অনন্ত রাঙামাটি (আদিবাসী)। সবমিলিয়ে গান, কবিতা আর সম্মেলক নৃত্যে বসন্ত উদযাপন করে নগরের ভালোবাসা প্রিয় মানুষেগুলো।  

সে ভালোবাসায় লাল, হলুদ আর বাসন্তী রঙা শাড়িতে তরুণীরা তখন মাথায় ফুলের মুকুট পরে, গালে আবির লাগিয়ে উৎসব উদযাপনে ব্যস্ত। বিভিন্ন বয়সী ছেলেরাও এসেছে নিজেদের প্রিয় রঙের পাঞ্জাবী আর ফতুয়া পরে। তবে সেসব রঙের ভাষাগত প্রকাশ করলো আয়োজনের বসন্ত কথান পর্বটি। এতে অংশ নেন বসন্ত উদযাপন কমিটির সহ-সভাপতি এবং আয়োজনের সভাপতি শফিউর রহমান, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট আবৃত্তি শিল্পী আহকাম উল্লাহ এবং সঙ্গীত শিল্পী মাহমুদ সেলিম। এসময় তারা সবাইকে বসন্তের শুভেচ্ছা জানান।

আবৃত্তি শিল্পী আহকাম উল্লাহ বলেন, বসন্তে শীতের আলস্য কাটিয়ে নতুন সূর্য ওঠে। গাছে গাছে নতুন পাতা ওঠে, নতুন ফুল ফোটে, তাই বসন্তকে ঋতুর রাজা বলা হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে কাটিয়ে এ আয়োজনে এতো নারীর উপস্থিতিতে এ ঋতুকে রাজা না বলে আমরা যদি রাজা-রানি বলি কিংবা ঋতুদের সাম্রাজ্য বলি, তাহলে আজকের সময়ে এসে তা অনেক বেশি সঠিক বলে মনে হবে।

সংগীত শিল্পী মাহমুদ সেলিম বলেন, বসন্ত জেগে ওঠার কাল, একই সঙ্গে মানুষেরও জেগে ওঠার কাল। আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, সবগুলোই বসন্তকালে। বসন্তকাল আনন্দের কাল, কিন্তু বসন্তকাল জেগে ওঠারও কাল, যেমন করে পাতারা জেগে ওঠে, তেমনি মানুষ জেগে ওঠে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্যে। সেজন্যেই বাঙালির কাছে বসন্তের অনেক মূল্য। বসন্ত অসাম্প্রদায়িক উৎসব এবং আমরাও অসাম্প্রদায়িক মানুষ। আমরা বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার প্রসারই চাই, সাম্প্রদায়িকতাকে বিনাশ করতে চাই। আমাদের বসন্তের শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

সভাপতি শফিউর রহমান বলেন, বসন্ত প্রকৃতির মধ্যে আসুক বা না আসুক, আমরা যারা মানুষ আছি, এ প্রকৃতির সঙ্গে মিশে বসন্তকে আমরা আবাহন করে নেবো আমাদের নিজেদের মননে, নিজেদের রঙে, নিজেদেরে আলোতে, ভালো লাগায়, প্রেমে।

উৎসবে সাংস্কৃতিক আয়োজনে ফাঁকে ছিল আবির মাখানো পর্ব। সে পর্বে আবির মাখিয়ে নতুন বন্ধুত্ব করেছে অনেকেই। একে অপরকে জানিয়েছে শুভেচ্ছা। সে রং যেনো লেগেছে সবার মরমে।

এ বছর বসন্তের উৎসর পূর্ণ করলো তাদের আয়োজনের ২৫ বছর। আয়োজন চলে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত আবারও আয়োজন চলবে চারুকলার বকুলতলায়। পাশাপাশি ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চ, লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুর শাহ্ পার্ক এবং উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্র স্মরণীর উন্মুক্ত মঞ্চে বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা অবধি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আয়োজক কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯
এইচএমএস/এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।