ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

খুলনার সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯
খুলনার সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না! খুলনার সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না!

খুলনা: ট্রাকচাপায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের ৫ নেতার রক্তের দাগ না শুকাতেই পিকনিকের বাস উল্টে এক স্কুলছাত্রী নিহত হলো খুলনার সড়কে। এর রেশ কাটতে না কাটতে ট্রাকচাপায় নিহত হন কলেজ শিক্ষক এবং মোটরসাইকেলের ধাক্কায় নিহত হন পাটকল শ্রমিক। ঘাতক ট্রাকচালকের বিচারের দাবিতে যখন বিএল কলেজ এলাকা উত্তাল ঠিক তখনই খুলনা মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীর প্রাণ গেল সড়কে।

গত চারদিন ধরে খুলনার সড়কে যেন মৃত্যুর মিছিল নেমেছে। একে একে ৯টি প্রাণ ঝরে গেল সড়কে।

আহত হলো ৩০ জন। সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এ মিছিল অপ্রতিরোধ্য। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে।  

ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছুঁই ছুঁই করছিলো খুলনা মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আরিফুল ইসলাম আকাশের (২২)। বুধবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) যখন পহেলা ফাল্গুলের উৎসবে মেতেছে সবাই তার রক্তে রঙ্গিন হয়েছে খুলনার সড়ক।

রূপসা সেতু বাইপাস সড়ক দিয়ে জিরোপয়েন্ট থেকে রূপসা সেতুর দিকে মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন আকাশ। পথে কোনো বড় গাড়ির চাপায় গুরুত্ব আহত হন তিনি। আরিফুলকে মোটরসাইকেলসহ পড়ে থাকতে দেখে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। নিহত আরিফুল ইসলাম আকাশের বাড়ি ফরিদপুর জেলায়।

মঙ্গলবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৭ টার দিকে ফুলতলার ১৪ মাইল এলাকায় সুপার জুট মিলের সামনের রাস্তা পারাপারের সময় নওয়াপাড়াগামী অজ্ঞাত মোটরসাইকেলের ধাক্কায় সুপার জুট মিলের কর্মচারী লুৎফর রহমান সরদার (৬৮) গুরুতর আহত হয়। তাকে দ্রুত হাসাপাতালে নেওয়ার পথেই তিনি মারা যায়। মোটরসাইকেল আরোহী ধাক্কা দিয়েই দ্রুত পালিয়ে যায়।  তিনি আলকা গ্রামের মৃত মোকতার সরদারের ছেলে।

একই দিন বিকেল ৩টার দিকে খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে যশোর-খুলনা মহাসড়কে সরকারি বিএল কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কিশোর কুমার পাল (৫৫) ট্রাকচাপায় নিহত হন।

ফুলতলা উপজেলার দামোদর পূর্বপাড়ায় নামযজ্ঞ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ফুলতলায় গিয়েছিলেন তিনি। ফেরার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার গিলেতলা বাজার এলাকার মৃত কিরণ চন্দ্র পালের ছেলে।

এদিকে বিএল কলেজের শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষব্ধ শিক্ষার্থীরা কান্না আর ভালোবাসা নিয়ে সড়ক অবরোধ ও মানববন্ধন করেছেন।

সোমবার (১১ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে খুলনার ডুমুরিয়ায় পিকনিকের একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে খাদে পড়ে মেঘলা নামের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হন আরও অন্তত ৩০ জন। সাতক্ষীরা-খুলনা সড়কের ডুমুরিয়ার চুকনগরের চাকুন্দিয়া এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

যশোরের শ্যামনগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় (স্কুলটির প্রস্তাবিত নাম যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজ) থেকে শিক্ষা সফরে বাগেরহাট যাচ্ছিল তারা।

এরআগে রোববার (১০ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ১০টার দিকে রূপসা সেতু বাইপাস সড়কে একটি প্রাইভেটকারের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকের সংঘর্ষ হয়। এতে গোপালগঞ্জের ছাত্র ও যুবলীগের পাঁচ নেতা নিহত হন। লবণচরা থানার সামনে খাজুর বাগান নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহত পাঁচজন হলেন- গোপালগঞ্জ শহরের সবুজবাগের অ্যাডভোকেট আবদুল ওয়াদুদ মিয়ার ছেলে ও গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুব হাসান বাবু, একই এলাকার মৃত আলাউদ্দিন শিকদারের ছেলে ও গোপালগঞ্জ সদর যুবলীগের সহ-সভাপতি সাদিকুল আলম, থানাপাড়ার গাজী মিজানুর রহমানের ছেলে ও জেলা ছাত্রলীগের উপ-সম্পাদক ওয়ালিদ মাহমুদ উৎসব, গেটপাড়া এলাকার আলমগীর হোসেন মোল্লার ছেলে ও জেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সাজু আহমেদ এবং চাদমারী এলাকার ওয়াহিদ গাজীর ছেলে ও জেলা ছাত্রলীগের সদস্য অনিমুল ইসলাম গাজী। এদের মধ্যে সাদিকুল গাড়ি চালাচ্ছিলেন।

খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক শাহীন আলম বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিন সড়কে যে হারে মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলছে তাতে আমরা স্বাভাবিকভাবে উদ্বিগ্ন, শোকাহত ও মর্মাহত। শিক্ষক, ছাত্র, সাধারণ মানুষসহ আমাদের ছাত্রলীগ ভাইয়েরা গত কয়েক দিনে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। যেটা একজন ছাত্র ও ছাত্রনেতা হিসেবে আমাকে খুবই শোকাহত ও ব্যথিত করেছে। সড়ক প্রশাসনের কঠোর তদারকি ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া এবং চালক, যাত্রীসহ পথচারীদের সচেতনার মাধ্যমে আমরা সড়কে শৃঙ্খলা আনতে পারি। একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না, তাই আসুন আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হই, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করি।

আক্ষেপ করে অনেকে বলছেন, খুলনার সড়কগুলো যেন ক্রমশই মরদেহের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই আরেকটি রক্তের দাগ এসে আরও লাল করে দিচ্ছে সড়কগুলো। এ ঘটনায় জড়িত চালকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান তারা।

নিহতের স্বজনরা বলছেন, এ হায়েনার দল চালকেরা। এতো এতো আন্দোলন হয়। তারপরও এদের হুঁশ হয় না। দুর্ঘটনায় জড়িত চালকদের ফাঁসি দেওয়ার হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমতো।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর খুলনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এস এম ইকবাল হোসেন বিপ্লব বাংলানিউজকে বলেন, আমরা সবাই জানি ও মানি মৃত্যু অনিবার্য। কেউ তা থামাতে পারবে না। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয়। স্বজন হারানোর বেদনা সারা জীবন বইতে হয়। প্রিয়জন হারানোর কষ্টের কোনো বর্ণনা হয় না। যে হারায় কেবল সেই বোঝে।

তিনি আরও বলেন, বেপরোয়া গাড়ি চালানোই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে বার বার চিহ্নিত করা হয়েছে। চালকদের বড় অংশই যে অদক্ষ, অপ্রশিক্ষিত, লাইসেন্সবিহীন, প্রতিযোগিতাপ্রবণ এবং ট্রাফিক আইন তোয়াক্কা না করা, সেটা বার বার পর্যবেক্ষণ, সমীক্ষা ও গবেষণায় উঠে এসেছে। এরপরও এদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ও তাতে হতাহতের ঘটনা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তিনি খুলনায় গত চারদিনে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচার দাবি করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯
এমআরএম/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।