রামু উপজেলা সদরের চৌমুহনী থেকে পুরনো আরাকান সড়ক ধরে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই ফতেখারকুল অফিসেরচর গ্রাম। সেখান থেকে ছায়া সুনিবিড় পথ ধরে একটু এগোলে লামার পাড়া বৌদ্ধবিহারের আগেই হাতছানি দেয় সারি সারি সুপারি গাছ।
রেঙ্গুনী কারুকাজে, দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্মে কাট দিয়ে তৈরি এ বিহারটির চমৎকার নির্মাণশৈলী যে কারোরই নজর কাড়ে। বিহারটির আঙিনা দিয়ে শান্ত-নিথর কিছুটা পথ মাড়িয়ে সামনে গেলেই চোখে পড়ে বড় বড় দু’টি পিতলের ঘণ্টা। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মতে, পিতলের তৈরি এ দু’টি ঘণ্টাই দেশের সবচেয়ে বড়। এখানে সংরক্ষিত আছে অষ্টধাতু নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি এবং প্রাচীন শিলালিপিসহ ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন। এসব প্রাচীন স্মৃতিচিহ্ন দেখে মন ভরে গেলেও সহজেই বোঝা যায় উপযুক্ত সংস্কার, পরিচর্যা এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাব।
চট্টগ্রাম থেকে সপরিবারে বেড়াতে আসা চিত্রশিল্পী আবু সাদাত ইবনে হোসেন সায়েম বাংলানিউজকে বলেন, প্রাচীন এই বৌদ্ধবিহার দেখে সত্যিই আমি মুগ্ধ। বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে ইট-পাথরের অনেক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা বা স্থাপত্যশৈলী দেখেছি, কিন্তু কাঠের তৈরি এই বিহারটির আবেদন অন্যরকম। বিহারটির ভেতরে-বাইরে প্রতিটি কাজের শিল্পমহিমা অসাধারণ। কিন্তু দেখে খারাপ লাগছে, সংস্কারের অভাবে চোখের সামনেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এমন অমূল্য একই পুরাকীর্তি।
‘দীর্ঘদিন ধরে আমি কানাডায় থাকি। দেশে এসেই রামুর বৌদ্ধবিহার দেখতে এলাম। সত্যিই বিহারটির শিল্পকর্ম দেখে আমি অভিভূত। অপূর্ব কারুকাজে কাট দিয়ে নির্মিত বিহারটির বাইরে যেমন নজরকাড়া, তেমনটি ভেতরেও অনিন্দ্যসুন্দর। মূল বিহারটির ভেতরে ছাউনির নিচের সিলিংয়ে যে অসাধারণ শিল্পসমৃদ্ধ কারুকাজ করা হয়েছে সেটা সত্যি দারুণ!’- বলেন একই দলের আরেক চিত্রশিল্পী তাবাচ্ছুম ফেরদৌসী তিতলী।
চট্টগ্রাম ডা. খাস্তগির সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফামী নাহিদা নাজনিন ইমন বাংলানিউজকে বলেন, এসব বৌদ্ধবিহার কেবল রামু-কক্সবাজারের নয়, গোটা দেশের গৌরবময় কীর্তি। এসব পুরাকীর্তি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ। সরকারের উচিত এসব পুরনো বিহারগুলো সংরক্ষণে এগিয়ে আসা।
লামার পাড়া ক্যাংয়ের (বৌদ্ধবিহার) বিহারাধ্যক্ষ ইয়ালাতারা ভিক্ষু বাংলানিউজকে জানান, ১৮০০ সালে তৎকালীন রাখাইন জমিদার উথোয়েন অংক্য রাখাইন এ বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। এক সময় এ বিহারের চারপাশে রাখাইন সম্প্রদায়ের বসতি ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় রাখাইনেরা এখান থেকে অন্যত্র চলে গেছে। যে কারণে বিহারটি হুমকির মুখে পড়ে।
ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার রাজারকুল, অফিসের চর, হাজারীকুল, পূর্ব রাজারকুল, মেরংলোয়া, শ্রীকুল, জাদিপাড়া, উখিয়ারঘোনা, উত্তর মিঠাছড়ি, উত্তর ফতেখাঁরকুলসহ বিভিন্ন এলাকায় মোট ২৭টি বৌদ্ধবিহার ও একটি জাদি রয়েছে। এর মধ্যে রাজারকুলে ৩০৮ খ্রিস্টপূর্বে সম্রাট অশোক নির্মিত ঐতিহাসিক রাংকূট বনাশ্রম বৌদ্ধবিহার, রামু সীমাবিহার, চেরাংঘাটা বড় ক্যাং, রামু মৈত্রীবিহার, সাদাচিং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে থাকলেও বাকি বিহারগুলো অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে। এর মধ্যে প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরনো হাজারীকুল রাখাইন বৌদ্ধবিহারটি ধ্বংস হয়ে গেছে। এলাকাবাসীর উদ্যোগে এটিকে নতুন করে তৈরি করার চেষ্টা চলছে। শ্রীকুল সাংগ্রীমা ক্যাং বর্তমানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। জাদিপাড়ায় প্রায় তিনশ’ ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর তৈরি করা জাদিটিও বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। পাহাড়টির চারপাশে গাইডওয়াল না থাকায় পাহাড় ধসে যেকোনো সময় জাদিটি ভেঙে পড়তে পারে। এতে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনাও। ইয়ালাতারা ভিক্ষু বলেন, এক সময় এ বিহারে ছোট-বড় অন্তত বিশটি ঘণ্টা ছিল। বুদ্ধমূর্তিও ছিল অনেকগুলো। সীমানা প্রাচীর (দেয়াল) না থাকায় দীর্ঘদিন বিহারটি অরক্ষিত থাকায় অনেক বুদ্ধমূর্তি, পিতলের ঘণ্টাসহ প্রয়োজনীয় মালামাল চুরি হয়ে গেছে। ২০০২ সালে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ এবং ভেতরে হাঁটার পথটি সংস্কার করা হয়। এতে চুরি বন্ধ হলেও সংস্কারের অভাবে দিনে দিনে বিহারটি জরাজীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সংস্কারের জন্য সাহায্য চেয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক আবেদন করা হলেও কোনো সাড়া মিলছে না।
রামু পুরাকীর্তি সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সীমাবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু এ বিষয়ে বাংলানিউজকে জানান, এক সময়ের বৌদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিলো অফিসের চরের লামার পাড়া ক্যাং। কিন্তু বর্তমানে নানা কারণে এ বিহারটির এখন জরাজীর্ণ অবস্থা। অথচ এ বিহারে এখনো সংরক্ষিত আছে অষ্টধাতুতে নির্মিত দেশের সর্ববৃহৎ বুদ্ধমূর্তিসহ অনেক ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন।
তিনি জানান, এক সময় রাখাইন সম্প্রদায় ওই বিহারটির দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণ করে এলেও বর্তমানে এর আশপাশে রাখাইন বসতি নেই। তাই সরকারিভাবে এটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া না হলে অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে এ অমূল্য পুরাকীর্তি।
রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন রামু শাখার সভাপতি উথোয়েনছি রাখাইন বাংলানিউজকে জানান, এখন কয়েক কোটি টাকা খরচ করলেও এরকম একটি বিহার তৈরি করা সম্ভব হবে না। কিন্তু কোটি কোটি টাকার এসব সম্পদ চোখের সামনে ধ্বংস যাচ্ছে। আমরা বিহারটি সংরক্ষণে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
যোগাযোগ করা হলে রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম বাংলানিউজকে বলেন, রামুতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক সহযোগিতায় প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২টি বৌদ্ধবিহার পুনর্নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। কাঠের তৈরি এসব পুরনো বিহারও পর্যায়ক্রমে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৯
এসবি/এইচএ/