আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা এ গানের সঙ্গে প্রতিবছরই আমরা বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মরণ করি। প্রভাত ফেরীতে খালি পায়ে স্মৃতির মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাই।
তবে ভুলতে বসেছি সেই বায়ান্নের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে যার বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিলো সেই সালামের স্মৃতি! এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভাষা শহীদ সালাম স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগারের কথা।
সারা বছর অব্যবস্থাপনায় খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে এটি। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই শুধু ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে ওঠে এই জাদুঘর ও পাঠাগার। এমনকি সালামনগরেও বেড়ে যায় নানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আনাগোনা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, প্রতিষ্ঠার প্রায় এক যুগ হতে চললেও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি ফেনীর ভাষা শহীদ আবদুস সালাম স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার। জাদুঘরে ভাষা শহীদের একটি পোট্রেট ছাড়া নেই তেমন কোনো স্মৃতি চিহ্ন নেই।
গ্রন্থাগারটি নিয়মিত না খোলা ও গ্রন্থাগারিক না থাকায় হতাশ হচ্ছেন পাঠকসহ দর্শনার্থীরাও। স্থানীয়দের ভাষ্য, প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি জাদুঘরের পাশে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আসেন। আর সারাবছর খবর রাখে না কেউ।
ফেনীর দাগনভূঁঞা উপজেলার মাতুভূঁঞা ইউনিয়নে সালামের বাড়ির পাশে জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে ১২ শতক জমির ওপর সালাম স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার নির্মাণ করা হয়। ২০০৮ সালে ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি স্মৃতি যাদুঘর শুধু নামেই। সেখানে শহীদ সালামের কোনো স্মৃতি চিহ্নটুকু নেই। গ্রন্থাগার পুরোনো বই দিয়ে সাজানো।
অপরদিকে এ গ্রন্থাগারটির দেখভালের দায়িত্বে আছেন স্থানীয় শেখ ফরিদ; তার বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিয়োগ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, তদারকির অভাবে তত্ত্বাবধায়ক শেখ ফরিদ গ্রন্থাগারে মাদকসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আড্ডা বসান। গ্রন্থাগারে পড়ার জন্য কোনো ধরনের স্থানীয় বা জাতীয় পত্রিকাও রাখা হয়নি।
মাতুভূঞাঁ ব্রিজ থেকে সালাম স্মৃতি জাদুঘরে যাওয়ার প্রধান সড়ক অনেকাংশই নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। সড়কটিকে স্থায়ী সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সড়কটির বেহাল অবস্থার কারণে এ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ, ভাষা শহীদ সালাম জাদুঘর ও গ্রন্থাগারে আগত দর্শনার্থী ও ভাষা শহীদ সালাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
স্থানীয়রা জানান, সালাম নগরে প্রায় সাত হাজার জনগণের বসবাস। আশপাশের গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ এ ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করেন। বর্ষা মৌসুমে রাস্তাটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট ফেনী নদীর প্রবল স্রোতে রাস্তাটি উল্লেখযোগ্য অংশ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। রাস্তাটির ভাঙন প্রতিরোধে দু’পাশে দেয়া হয়েছে বাঁশের খুঁটি। বিষয়টি একাধিকরা সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানালেও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ করেন তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা কবির আহম্মদ বলেন, বৃষ্টির কারণে বর্ষাকালে রাস্তাটি ভেঙে গেছে। ফলে মানুষ সালাম জাদুঘরে আসতে পারছেন না।
ভাষা শহীদ সালামের ছোট ভাই আবদুল করিম জানান, ভাষা শহীদ আবদুস সালাম স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারে আসার জন্য রাস্তা ছিল, একটি সাইনবোর্ডও ছিল। এখন নদী ভাঙনে রাস্তা ভেঙে গেছে। রাস্তাটি মেরামতে সরকার দু’বার উদ্যোগ নিলেও, তা হয়নি। তিনি রাস্তাটি পুনঃমেরামতের দাবি জানান।
আক্ষেপ করে আবদুল করিম বলেন, মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বিশ্ব দরবারে ইতিহাস গড়েছে বাঙালি জাতি। এ অর্জন বাঙালির শতাব্দীকালের অর্জন হলেও যারা লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের ব্যাপারে অবহেলা যেন দিনে দিনে বাড়ছে।
‘দীর্ঘদিন ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে পর ভাইয়ের (সালাম) কবরটি শনাক্ত করা গেলেও সেখানে সীমানা প্রাচীর দেয়া যাচ্ছে না। কে বা কারা সেটা বারবার ভেঙে ফেলছে। ’
ভাষা শহীদ আবদুস সালাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুর জাহান বেগম বলেন, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে রাস্তাটি সংস্কার হচ্ছে না। এতে আমাদের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের আসা-যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। ফলে দিন দিন বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সড়কটি সংস্কার হলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা আরও বাড়বে।
দাগনভূঞা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম ভূঞা বলেন, আমরা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি, যাতে অল্প সময়ে স্বল্প দূরত্বের রাস্তাটি সংস্কারের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করে সঙ্কট নিরসনের জন্য উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন জেলা পরিষদ প্রশাসক আজিজ আহম্মদ চৌধুরী।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, কর্তব্য অবহেলার কারণে আগের গ্রন্থাকারিককে ছাঁটাই করে দেয়া হয়েছে। শিগগিরই নতুন গ্রন্থাগারিক নিয়োগ দেয়া হবে। সড়ক নির্মাণ ও সংষ্কারের ব্যাপারে পরিকল্পনা হাতে রয়েছে।
ভাষা শহীদ সালাম:
শহীদ সালামের ভাই আবদুল করিম জানান, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বায়ান্ন’র উত্তাল সময়ে চলমান আন্দোলন টগবগে তরুণ সালামের হৃদয়ও ছুঁয়ে যায়। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ১৪৪ ধারা জারি করলেও তা অগ্রাহ্য করে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিলে নামে ছাত্র-জনতা। সে মিছিলে অদম্য সাহসে অংশগ্রহণ করেন সালামও।
আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে পড়লে মিছিলে পুলিশ নির্বাচারে গুলি চালায়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ গুলিবিদ্ধ হন অনেকে।
গুরুতর আহত অবস্থায় আবদুস সালামকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ২৫ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ফেনীর গর্বিত এই সন্তন। পরে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে সালামের মৃতদেহ ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৪৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯
এসএইচডি/এমএ/