ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

একুশের ইতিকথা

ময়মনসিংহে নারীদের বাঁধভাঙা জোয়ার

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯
ময়মনসিংহে নারীদের বাঁধভাঙা জোয়ার নারীদের বাঁধভাঙা জোয়ার

অগ্নিঝরা ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল ঢাকা। রক্তাক্ত রাজপথ। প্রতিবাদ আর দ্রোহের আগুনে উত্তপ্ত সারাদেশ। শিক্ষা ও সংস্কৃতির শহর ময়মনসিংহেও ওঠে ভাষা আন্দোলনের ঝড়।

সেই সময়কার ঘটনা প্রবাহ নিয়ে ৪ পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান। পড়ুন প্রতিবেদনটির দ্বিতীয় কিস্তি।

ময়মনসিংহে ভাষা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণের অধ্যায় গৌরবোজ্জ্বল। ওই সময়কার উত্তাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়া নয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা সারা তৈফুর মাহমুদ।

বছর কয়েক আগে তিনি মারা যান।

শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার নেতৃত্বে মেয়েরা অবিরাম ছুটেছেন। রাত জেগে পোস্টার লিখতেন। পরে সেই পোস্টার তুলে দিতেন ছাত্রদের হাতে। তাদের কাজ ছিলো শহরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটিয়ে দেওয়া।

মুসলিম গার্লস হাইস্কুলে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে ছাত্রীদের উদ্দেশে বক্তব্য রেখেছিলেন ভাষা আন্দোলনের এই প্রয়াত কর্মী।

মৃত্যুর আগে ২০১৩ সালে বাংলানিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি স্মৃতির পাতা উল্টে বলেছিলেন, “সেদিন আমার বক্তব্য শেষ হতেই মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের কয়েকজন মেয়ে আমার সঙ্গে চলে আসে। মনে আনন্দের প্লাবন বয়ে যায়।

এরপর সেদিন আমি তাদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মেয়েদের নিয়ে একটি মিছিল করেছিলাম। ওই সময় আরো মিছিল বের হয়েছিলো। ”

ময়মনসিংহে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করেছেন ভাষা সৈনিক তাহমিদা সাঈদা। তখন তিনি আনন্দমোহন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের বিক্ষোভ মিছিলে আনন্দমোহন কলেজের ছাত্রীরা দলে দলে অংশ নেন। সে ছিলো বাঁধভাঙা জোয়ার।

ভাষা আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশে ছাত্রীরা নিয়মিত অংশ নেন। ছাত্রী মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ায় তাহমিদা সাঈদা ১৫ দিন গৃহবন্দি ও নজরবন্দি ছিলেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি রোববার ছিলো সাপ্তাহিক ছুটি। কিন্তু এদিনও ময়মনসিংহে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।

ময়মনসিংহে ভাষা আন্দোলনে অন্যতম প্রধান সংগ্রামী নারী ছিলেন মমতাজ বেগম। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে তিনি চরমভাবে লাঞ্ছিত, নির্যাতিত এবং দীর্ঘ সময় কারাবরণ করেন।

কলকাতার হাওড়া জেলার শিবপুরে জন্ম নেওয়া এই নারী ’৪৭ এর দেশভাগের পর ময়মনসিংহ চলে আসেন এবং শহরের বিদ্যাময়ী স্কুলে সহকারী শিক্ষিকা পদে ৭ মাস শিক্ষকতা করেন।

তবে তার সম্পর্কিত কোনো তথ্য বিদ্যালয়টিতে সংরক্ষণ নেই বলে বাংলানিউজকে জানান শহরের বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার।

ভাষা আন্দোলনে ময়মনসিংহে ছাত্র আন্দোলনে এম শামসুল হকের ভূমিকাও ছিলো উল্লেখযোগ্য। তিনি পরবর্তীতে ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) আসন থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি।

তেমনি ভালুকার কৃতি সন্তান ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট মোস্তফা এম.এ. মতিন রাজধানীতে ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তিনিও ময়মনসিংহ-১১ (ভালুকা) আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ময়মনসিংহে জেলা পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনে সংগঠক ও নেতৃত্বদানকারী অর্ধশত নেতার ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২৫ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ শহরে ছাত্র জনতা অবস্থান ধর্মঘট করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি শহরে পূর্ণ দিবস হরতাল পালিত হয়। এতে অফিস-আদালতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলনের তীব্রতা দিন দিন বাড়তে থাকে। ময়মনসিংহে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দমনে শাসক গোষ্ঠী কঠোর অবস্থান নেয়।

স্থানীয় ২৩ জন নেতার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা আইনের অধীনে পাকিস্তান সরকার মামলা করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ২২ জন নেতাকে পুলিশ অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে।

গ্রেফতার হন সৈয়দ বদর উদ্দিন হোসাইন, এম শামসুল হক, মোজাম্মেল হক, হাতেম আলী তালুকদার, অ্যাডভোকেট হাশেম উদ্দিন, মীর কফিল উদ্দিন লাল মিয়া, মহাদেব সান্যাল, আহাম্মদ সালেক, আব্দুর রহমান সিদ্দিক, কাজী আব্দুল বারী, অ্যাডভোকেট আব্দুর রশিদ, মতলুব আনাম গোড়া মিয়া, মীর আমির হোসেন প্রমুখ। ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন রফিক উদ্দিন ভূইয়া।

৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ। এই পরিষদের অন্যতম নেতা ছিলেন নান্দাইলের গর্ব খালেক নেওয়াজ খান। ভাষা সৈনিক খালেক নেওয়াজ খান ও ভাষা সৈনিক মোস্তফা এম এ মতিন গ্রেফতার হন। প্রায় তিন মাস কারাভোগ করেন।

পরে মোস্তফা এম এ মতিন বাদী হয়ে ১৯৬৭ সালে উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার জন্য রিট পিটিশন দায়ের করেন।

ভাষা আন্দোলনে ময়মনসিংহ শহর ছাড়াও গফরগাঁও, মুক্তাগাছা, গৌরীপুর, দুর্গাপুর, শেরপুর এলাকায় তীব্র আন্দোলন হয়।

২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ শহরের বিপিন পার্কে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ও রাজধানীতে ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিলে পুলিশের নির্বিচারে গুলির প্রতিবাদে বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, প্রখ্যাত লেখক আবুল মনসুর আহামদ সভাপতিত্ব করেন।

ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা ছিলো ময়মনসিংহের অহংকার সৈয়দ নজরুল ইসলামের। ৫২ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এস.এম হলের ভিপি। অবিভক্ত ময়মনসিংহের কৃতি সন্তান শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু বিশ্বস্ত সহচর, জাতীয় ৪ নেতার অন্যতম নেতা, ৭১ সালে গঠিত মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৮
এমএএএম/এমজেএফ

***জব্বারের রক্তে উত্তাল ময়মনসিংহ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।