এ ধরনের উচ্চারণের ফলে তাদের মুখে ‘খেয়েছি’ শব্দটি উচ্চারিত হয় ‘খেয়েচি’-এর মতো, আবার ‘আমার’ শব্দটি উচ্চারিত হয় ‘আমাড়’ এর মতো। আর এ ধরনের হাজারো শব্দ বিকৃত হয়ে এখন ঘুরছে বাঙালির মুখে মুখে।
বিষেশজ্ঞদের মতে, দূষণ ও বিকৃতিতে বাংলা ভাষা বিপর্যয়ের পেছনে আর্থসামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব, শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিসহ আরও অনেক বিষয় সম্পৃক্ত। আবার ধনীদের সবাই অনুসরণের ফলে ইংরেজি চর্চা এবং বাংলায় মনোযোগ না থাকাকেও কারণ বলে মনে করেন তারা।
বাংলা ভাষার এমন অবস্থা সম্পর্কে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমাদের এখানে সমাজ শ্রেণীবিভক্ত। গরিবরা শুদ্ধ বাংলা জানে না আর মধ্যবিত্তরা ভাষার চর্চা করলেও তারা এখন বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে আছে।
তিনি বলেন, ধনীদের সবাই অনুসরণ করে। কিন্তু তারা ইংরেজি চর্চা করে, বাংলায় মনোযোগ নেই। ভুল ইংরেজি লিখলে লজ্জা পায় কিন্তু ভুল বাংলা লিখলে উল্টো গৌরব বোধ করে। মিডিয়াও অনেকে কিছু বিকৃত করছে। যারা বিত্তবান তাদেরকে লক্ষ্য করেই সব ধরনের প্রচার চলছে।
তারা মনে করে, বিজ্ঞাপনের ভাষা স্মার্ট হবে যদি সেখানে মিশেল থাকে। বাণিজ্য ও বিত্ত নষ্ট করছে সব। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এ অবস্থা চলছে। এ অবস্থা রুখতে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক দক্ষ শিক্ষকও সেভাবে দিতে পারিনি আমরা।
ক্রমশ ভাষার এই বিকৃতি বাড়তে থাকায় শংকা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিকৃতির কারণ হিসেবে কিছু নাটকে এ ধরনের ভাষার ব্যবহার, রেডিও জকির ভাষা এবং সম্প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত কিছু বিজ্ঞাপনের সংলাপকেও চিহ্নিত করেছেন তারা। তাদের মতে বিভিন্ন পর্যায়ে ধাপে ধাপে বিকৃতির ফলে বাংলা ভাষা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।
তবে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই বলে মতামত ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যতম প্রাণপুরুষদের। একইসঙ্গে সরকার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরও সরাসরি সম্পৃক্ত করার প্রতি জোর তাদের।
এ বিষয়ে ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক বলেন, ভাষার অশুদ্ধ উচ্চারণ রোধ করতে গেলে সরকারকে সরাসরি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সরাসরি সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে আইন করতে হবে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে আন্দোলন করতে হবে যে, আমরা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবো, আমরা শুদ্ধ ভাষায় লিখবো, অর্থাৎ নির্ভুল ভাষায় লিখবো। এছাড়া পথে সাইনবোর্ড বা বিজ্ঞাপনগুলোতে যেন সঠিক বানানে লেখা হয়। এটা একটি ভাষিক আন্দোলন, বানানভিত্তিক আন্দোলন, শুদ্ধ বানানের আন্দেলন গড়ে তোলা দরকার। সেটি করতে পারলেই এগুলো রোধ করা যাবে।
এর আগে ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শিরোনামে টেলিভিশনে বিকৃত উচ্চারণে এবং ভাষা ব্যঙ্গ করে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। বিটিআরসির চেয়ারম্যান, সংস্কৃতি সচিব, তথ্য সচিব, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের মহাপরিচালক, সব বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও এফএম রেডিওর প্রধান কর্মকর্তাদের প্রতি এ অন্তবর্তী আদেশ জারি করা হয়।
স্বপ্রণোদিতভাবে (সুয়োমটো) দেওয়া ওই আদেশে আদালত বলেছেন, বাংলা ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করতে সর্বোতভাবে চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, ভিন্ন ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ, সঠিক শব্দ চয়ন না করা এবং বাংলা ভাষার অবক্ষয়রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে- সে বিষয়ে সুপারিশ দিতে বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে প্রধান করে একটি কমিটি করার আদেশ দেন আদালত। কমিটি ২০১৩ সালের মাঝামাঝি একটি প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পরে মন্ত্রণালয় প্রতিবেদনটি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেয় বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯
এইচএমএস/এএটি