ময়মনসিংহ: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখরিত ছিলো ময়মনসিংহের রাজপথ। বায়ান্নো’র একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গোটা সপ্তাহজুড়ে ময়মনসিংহ ছিলো উত্তাল।
ময়মনসিংহ শহরে একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেলে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি টাউনহল প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সভা হয়। গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ। এরপর দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি বিপিন পার্কে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল জনসমাবেশ।
ছাত্র জনতার বিক্ষোভে অচল হয়ে পড়ে ময়মনসিংহ শহর। আন্দোলন সংগ্রামে দমন পীড়ন চালায় সরকার। গ্রেফতার, মামলা ও হুলিয়ার মুখে পড়েন ভাষা আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা।
ময়মনসিংহে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল যুগপৎ ব্যাপক মাত্রায়। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, শিক্ষক-ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন।
এ আন্দোলনে রাজধানী ঢাকার উত্তাপ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সূত্রে ভাষা আন্দোলনে আঞ্চলিক পর্যায়ের সংগ্রাম মুখর দিনগুলোর ইতিকথাও আজ ইতিহাসের অংশ। স্থানীয় পর্যায়ের সেই ইতিহাস এখন গুরুত্বের সঙ্গে চর্চা হয়।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে রয়েছে ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার মিলনায়তন। ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের প্রশাসক থাকাকালে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকা ময়মনসিংহের এ কৃতি মানবের নামে এই মিলনায়তনের নামকরণ করেন।
শহরের অ্যাডভোকেট তারেক স্মৃতি অডিটোরিয়ামের পাশেই ভাষা সৈনিক এম শামসুল হক মঞ্চ করেছে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন। স্থানীয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিপরীতে রয়েছে এই উন্মুক্ত মঞ্চ। যেখানে রয়েছে তার প্রতিকৃতি।
শহরের ব্রক্ষপুত্র নদঘেষা জয়নুল উদ্যানে ভাষার জন্য আত্মদানকারী বীর শহীদের স্মৃতি রক্ষায় নির্মাণ করা হয়েছে ভাষা সৈনিক মোস্তফা এম এ মতিন স্মৃতি পাঠাগার।
ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র থাকাকালে ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সিটি করপোরেশনের বর্তমান প্রশাসক, মহানগর আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা মো. ইকরামুল হক টিটু ভাষা সৈনিক মোস্তফা এম. এ. মতিনের দুই মেয়ে ফেরদৌস সুলতানা ও নিগার সুলতানাকে সঙ্গে নিয়ে এ পাঠাগারের উদ্বোধন করেন।
পাঠাগারটিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, সায়েন্স ফিকশন, শিশুতোষ, ভ্রমণ কাহিনীসহ প্রায় ৩ হাজারের মতো বই। পাঠক শ্রেণি ও জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ভাষা শহীদ মোস্তফা এম এ মতিনের নিজ জন্মভূমি ভালুকা উপজেলায় প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি স্থানীয়ভাবে সপ্তাহব্যাপী বইমেলার আয়োজন করা হয়।
শহীদ দিবসের মহানায়কদের একজন আব্দুল জব্বার। যিনি রক্ত দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য জীবন দেওয়া গফরগাঁওয়ের পাচুয়া গ্রামের এ জব্বার সাধারণ থেকে হয়ে ওঠেছেন অনন্য সাধারণ। জব্বারের আত্মদান ময়মনসিংহকে তেজময় আবেগে বিক্ষুব্ধ করেছিলো।
২০০৮ সালের দিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামে তার স্মৃতি সংরক্ষণ, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি বাংলা ভাষার ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানাতে ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে।
এ গ্রন্থাগারে রয়েছে হাজার চারেক বই। তবে এ গ্রন্থাগারটি সব সময় পাঠক শূন্যই থাকে। তবে অবাক করা ব্যাপার এ স্মৃতি জাদুঘরে এই ভাষা শহীদের ব্যবহৃত কোনো জিনিসপত্র নেই। ফলে হতাশা নিয়েই ফিরতে হয় দর্শনার্থী ও পাঠকদের।
এই গ্রামেই রয়েছে ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার স্মৃতি বিদ্যালয়। ২০০৫ সালে সরকারিভাবে এই গ্রামেই প্রথম শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর আগে কলাগাছের তৈরি শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ করা হতো।
স্থায়ীভাবে শহীদ মিনার নির্মাণের পর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’-গান কন্ঠে নিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে শহীদ এ বীর সন্তানকে। দিনমান আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলায় নানা বয়সী মানুষের প্রাণের আবেগে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে জব্বার নগর।
ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বাদল বাংলানিউজকে বলেন, ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি। এছাড়াও গফরগাঁও পৌরসভা কার্যালয় সংলগ্ন অডিটরিয়ামটিও তার নামে নামকরণের দাবি জানাচ্ছি।
ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ বাবেল বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্বের মানচিত্রে ভাষার জন্য প্রথম আত্মদানের ইতিহাস এক চিরভাস্বর উপাখ্যান। আমি মনে করি আমাদের গর্ব এ বীর সন্তানের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতি গ্রন্থাগারটি একদিন বাংলা ভাষা চর্চা ও জ্ঞান বিভাগের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯
এমএএএম/এসএইচ