ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বাংলাদেশের প্রধান দুঃখ ‘দুর্নীতি’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৯
বাংলাদেশের প্রধান দুঃখ ‘দুর্নীতি’ দুর্নীতিদমন কমিশন। ছবি: রহমান মাসুদ

ঢাকা: ‘বাংলাদেশের প্রধান দুঃখ দুর্নীতি। এ বিষয়ে আমাদের অনেক হতাশাও রয়েছে। তাই দুদকের কাছে মানুষের আশাও গগণচুম্বী। তবে বলতেই হয়, দুদক কাজ করার চেষ্টা শুরু করেছে।’

সোমবার দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে  কমিশনের কৌশলপত্র -২০১৯  এর ওপর এক মতবিনিময় সভায় এ মন্তব্য করেন বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ।

তিনি বলেন, ‘একদিনে এটা হবে না।

রাতারাতি এটা করা কঠিন। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কয়েকটি দৃশ্যমান ঘটনা ঘটাতে হবে। রাতারাতি সবকিছু আশা করলে হতাশ হতেই হবে। তবে আশার কথা রাষ্ট্র ধীরে ধীরে দৃঢ় হচ্ছে। রাষ্ট্র আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সংহত হচ্ছে। ’

মতবিনিময় সভায় সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও রাষ্ট্রদূত মোঃ জমির বলেন, ‘বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় দুদকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বচ্ছতা না থাকলে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয় না। ’

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দুদকের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠার পরিবশে সৃষ্টি করতে হবে। কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্র  এখন পয়সা উপার্জনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার মানের চরম অবনতি ঘটছে। যদি সক্ষম এবং দক্ষ শ্রমশক্তি না থাকে তাহলে এদেশে কাঙ্খিত মাত্রার বিনিয়োগ আসবে না। ’

সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন বলেন, ‘কমিশনের  মিশনে ‘দুর্নীতির গতি প্রকৃতি নির্নয়’  থাকা উচিত। কাজের মধ্যে স্বচ্ছতার দৃশ্যমান মানদণ্ড থাকবে। স্বচ্ছতা আপেক্ষিক। তাই এর একটি মানদণ্ড থাকা উচিত। কমিশনের প্রতি মানুষের ভয় ও শ্রদ্ধা থাকলে দুর্নীতি প্রতিরোধ কিছুটা সহজ হবে। ’

সিপিডির  নির্বাহী পরিচালক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দুর্নীতি দমনকে আইনি প্রক্রিয়ায় না দেখে এটিকে উন্নয়নের প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। দুর্নীতি দমন করা না গেলে ২০৪১ সালের উন্নত দেশ বিনির্মাণ কঠিন হবে। ’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী কোচিং বাণিজ্য বন্ধে দুদকের সক্রিয় ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি ব্যাংকিংখাতে দুদকের আরো সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। ’

এমআরডিআই প্রধান হাসিবুর রহমান মুকুর বলেন, ‘দুদক, তথ্য কমিশন এবং সিএজির মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন। ’

গণমাধ্যম ব্যাক্তিত্ব মো. জাহাঙ্গীর জানান, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্মচারীদের বড় বড় দুর্নীতি বেরিয়ে আসছে। এসব ক্ষেত্রে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কিংবা সচিবদের কি কোনো দায়বদ্ধতা নেই! নতুন তিনটি ব্যাংক অনুমোদেনের সমালোচনা করে তিনি এ বিষয়েও দুদকের তদন্তের আহ্বান জানান।

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলমা মজুমদার বলেন, দুদকের উচিত মেগাখাতের দুর্নীতি দমনে অধিকতর মনোনিবেশ করা উচিত।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ’র (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচিত দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা যুক্ত থাকলে দুর্নীতি দমন হবে অবাস্তব চেষ্টা। দুর্নীতি দমনে তাই রাজনৈতিক সদিচ্ছার দৃশ্যমান প্রকাশ দরকার।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, আমরা যারা বড়, বুড়ো, আমাদের পরিবর্তন করা কঠিন। আমাদের আগামী দিনের বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সচেতন করতে হবে। এজন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে।

সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ছোট বা বড় দুর্নীতি যাই হোক না কেনো, আইনের চোখে সবই সমান। এটা যারা বিভাজন করেন, তারা অজ্ঞ।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অবঃ) আবদুর রশীদ বলেন, দুর্নীতি একটি খারাপ সংস্কৃতি। শিক্ষা-স্বাস্থ্যে দুদক হস্তক্ষেপ করলে সমস্যা কোথায়। শিক্ষক যদি পড়াতে না আসে সেটাও দুর্নীতি, বেতন নিয়ে চিকিৎসা না দিলে সেটাও চিকিৎসকের দুর্নীতি। তাই রাজনৈতিক চিন্তা মাথায় না রেখে সমাজের কথা বিবেচনা করে কাজ করতে পারলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

মতবিনিময় সভায় অন্যন্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্র দূত হুমায়ুন কবির, কণ্ঠশিল্পী হায়দার হোসেন প্রমুখ।

সভায় সভাপতির বক্তব্যে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন এই সমাজের বাইরের কোনো অংশ নয়। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, বিগত তিন বছরে সরকার  রাজনৈতিক দল কিংবা কথিত ক্ষমতাবানরা কেউ দুদককে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেননি। আমরা নিজেরা নিজেদের প্রভাবিত ভাবতে পারি, বাস্তবতা হচ্ছে কেউ আমাদেরকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করারও সাহস পাননি। আমরা কেউ-ই ধোয়া তুলসির পাতা নই। তবে আমরা আমাদের ভুলটা স্বীকার করি, দুর্বলতা অস্বীকার করি না। ’

তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলেন মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যর্থতার জন্য দুদকের দিকে অঙুল তোলা হয়। বাস্তবতা হচ্ছে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে মানিলন্ডারিং মামলা পরিচালনার একক দায়িত্ব দুদকের হাতে না রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর),  পুলিশের সিআইডি, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ একাধিক সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দুদক কেবল ঘুষ ও দুর্নীতিসম্পৃক্ত মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধ তদন্তের ক্ষমতাপ্রাপ্ত। বাকি ২৬ টি সম্পৃক্ত অপরাধ সংশ্লিষ্ট মানিলন্ডারিংয়ের তদন্ত অন্যান্য সংস্থাসমূহের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ’

ইকবাল মাহমুদ বলেন, ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি একক সেক্টর  হিসেবে সর্বোচ্চ মামলা এবং গ্রেফতার হয়েছে ব্যাংকিং সেক্টরে। বেসিক ব্যাংকের ৫৬টি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে আরো মামলাও হতে পারে। ব্যাংকার, ব্যবসায়ী যারা আসামি তারাও দ্রুত মামলার চার্জশিট চান। আমরা চেষ্টা করছি, তবে ব্যাংকের টাকাটা কিন্তু জনগণের। এছাড়া আমরা অপরাধীদের পিছনে নিরবচ্ছিন্নভাবে আইনি অভিযান অব্যাহত রাখবো। কাউকেই ছাড় দেব না। কমিশন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী। আশা করি সকলের সম্মিলিত সহযোগিতায় দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হবো।

বাংলাদেশ সময়: ২৩৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৯
আরএম/এইচএমএস/এমকেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।