অতি দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ আবাসিক এলাকা থেকে সরানোর জন্য প্রকল্প নেওয়া হয় এক বছর আগে। অথচ প্রকল্পের এক শতাংশও বাস্তবায়ন হয়নি।
জীবনের তাগিদে নিমতলীবাসী কর্মব্যস্ত হয়ে উঠলেও এখনও তারা বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই দুঃসহ স্মৃতি। আবার যেন একই দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য নিমতলীবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কেরানীগঞ্জে আলাদা কেমিক্যাল পল্লি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২০২ কোটি ৩১ লাখ টাকা। প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে দেশের সব কেমিক্যাল গোডাউন কেরানীগঞ্জে নেওয়া হবে।
চলমান প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই। ৫০ একর জমিতে চার হাজার কেমিক্যাল গোডাউন স্থানান্তরের কথা ছিলো। তবে প্রকল্পের আওতায় জমি পাওয়া যায়নি। চার হাজার কেমিক্যাল গোডাউন স্থানান্তরের কথা থাকলেও আরও পাঁচ হাজার গোডাউন স্থানান্তর করা হবে। শুধু ঢাকা নয় অন্যান্য জেলার কেমিক্যাল গোডাউনও স্থানান্তর করা হবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সূত্র জানায়, শুধু পুরান ঢাকা নয়, মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে প্রায় ৯ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এসব কেমিক্যাল গোডাউন স্থানান্তরে ২৫০ একর জমির প্রয়োজন। মাত্র ৫০ একর জমিতে হবে না।
প্রকল্পের পরিচালক সাইফুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, চলমান প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য। কেমিক্যাল গোডাউন স্থানান্তরে দরকার মোট ২৫০ একর জমি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিলাম চার হাজার কেমিক্যাল গোডাউন স্থানান্তর করবো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে শুধু পুরান ঢাকা নয় এর আশেপাশে ৯ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন হবে।
তিনি আরও বলেন, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৯ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন ও কারখানা রয়েছে। এসব গোডাউন ও কারখানায় বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ থাকায় আবাসিক এলাকার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এগুলো কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে বিসিক।
প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক বলেন, জমি না পাওয়ায় প্রকল্পের অগ্রগতি নেই।
বিসিক সূত্র জানায়, কেরানীগঞ্জে ৫০ একর জমিতে ‘বিসিক কেমিক্যাল পল্লি’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গায় সব ধরনের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।
এসিড, বিস্ফোরক এবং বিভিন্ন কেমিক্যালকে তিনভাগে বিভক্ত করে কেমিক্যাল পল্লিতে তিনটি জোন করা হবে। প্রত্যেক ট্রেড লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীকে ৪শ’ বর্গফুট করে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হবে। আর কেমিক্যাল আমদানিকারকদের নাম সংগ্রহ করবে বিসিক।
প্রকল্পের আওতায় প্রশাসনিক ভবন, পাম্প ড্রাইভার কোয়ার্টার, ফায়ার ব্রিগেড, স্টাফ কোয়ার্টারও নির্মাণ করা হবে। কেমিক্যাল পল্লিতে থাকবে শিল্পনগরীর সীমানা প্রাচীর, প্রবেশপথ, ডাম্পিং ইয়ার্ড, ড্রেন, বক্স কালভার্ট, নলকূপ, পানি সরবরাহ লাইন ও ফায়ার সার্ভিস।
কেমিক্যাল স্থানান্তরে বিসিকের কথায় বিশ্বাস করতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে চকবাজারের হায়দার বক্স লেনে কেমিক্যাল থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় ১৮ জন অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন। তখন থেকেই কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর দাবি স্থানীয়দের।
এরপর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় গত ২০ ফেব্রুয়ারি। সেদিন রাতে চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা যান ৬৭ জন। আহত হন আরও অনেক। এখানকার নন্দকুমার দত্ত রোডের শেষ মাথায় চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশে ৬৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের ওয়াহিদ ম্যানশন ঘিরে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। আবাসিক ভবনটিতে কেমিক্যাল গোডাউন থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
অগ্নিকাণ্ড হলে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর উদ্যোগ বাড়ে। কিছুদিন পরে এই উদ্যোগ থেমে যায় বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
চকবাজার মাওড়ারটেকের বাসিন্দা হাজী আওলাদ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, কেমিক্যাল না মনে হয় আমরা জমের সঙ্গে বাস করি। কেমিক্যালে আগুন লাগে মানুষ মারা যায়, সরকারের উদ্যোগ বাড়ে। মরদেহের দাফন শেষে আর খবর থাকে না।
চকবাজার পূর্ব ইসলামবাগ এলাকায় অধিকাংশ বাসার নিচে রয়েছে কেমিক্যাল গোডাউন ও ছোট ছোট কলকারখানা। তবে জুতা কারখানায় বেশি হারে ব্যবহার করা হয় কেমিক্যাল।
পূর্ব ইসলামবাগের বাসিন্দা শরিফুল হক চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, সাধারণত বাসার নিচতলা কেমিক্যাল ও জুতার কারখানার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। সাধারণত তিন রুমের বাসা ১০ হাজার টাকা ভড়া হলেও কারখানার জন্য দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা যায়। এজন্য কেমিক্যাল ও জুতার কারখানার জন্য বাসাভাড়া দেওয়া হয়। আমরা আবাসন এলাকায় এসব মরণফাঁদ চায় না। সরকার বলে কেমিক্যাল সরাবে। কিছুদিন গেলেই খবর থাকে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৯
এমআইএস/আরআর