ঢাকা: রাজধানীর আগারগাঁও তালতলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাড়ে ৩ কোটি টাকার পোস্টাল জালিয়াতির দায়ে স্বামী-স্ত্রীকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১)। পোস্টাল জালিয়াতি ছাড়াও এই দম্পতি মিলে দীর্ঘদিন ধরে নানাবিধ প্রতারণা চালিয়ে আসছিল।
রোববার (৩ জানুয়ারি) ভোরে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তালতলা এলাকা থেকে তাদেরকে আটক করা হয়। আটকরা হলেন, ফজুলল হক আশরাফ (৫২) ও তার স্ত্রী আছমা আক্তার শিমু (৩৮)।
এসময় তাদের কাছ থেকে নগদ দেড়লাখ টাকা, জিপিওর বিপুল পরিমাণ সিল এবং মানি অর্ডারের ফরম উদ্ধার করা হয়।
পরে তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রোববার বিকেলে জিপিও'র ৩ জন কর্মচারী এবং তাদের সহযোগী আরা ১ জন সিভিলিয়ানকে আটক করা হয়। আটক হওয়া অন্যরা হলেন- আমজাদ আলী (৫৫), মোস্তাফিজুর রহমান (৫২), ডলি রাণী সাহা (৫৩) ও লিংকন সাহা (২৪)।
র্যাব জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা জিপিও'র উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন যে, একটি প্রতারক চক্র পোস্টাল মানি অর্ডার জাল করে অভিনব উপায়ে টাকা উত্তোলন করছে। গত জুন-জুলাই এর দিকে কয়েক হাজার জাল মানি অর্ডারের সন্ধান পাওয়া যায়। শুধুমাত্র ঢাকা জিপিওতে এই রকম ৮ হাজার জাল মানি অর্ডারের পাওয়া যায়।
এছাড়া, মিরপুর ও নিউমার্কেট পোস্ট অফিসেও এখন পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক জাল মানি অর্ডারের সন্ধান পাওয়া যায়। সন্দেহভাজন প্রতারক হিসেবে জিপিও কর্তৃক ফজলুল হক, আবুল বাশার এবং শিমু বেগমের নামে মামলা করা হয়। মামলার পর আসামিরা আত্মগোপনে চলে যায়। পরবর্তীতে এই বিষয়ে সহায়তা চেয়ে র্যাবের কাছে অভিযোগ করে জিপিও কর্তৃপক্ষ।
এরই ধারাবাহিকতায় রোববার (০৩ জানুয়ারি) ভোরে তালতলা এলাকায় অভিযান পরিচালনা চালিয়ে পোস্টাল সার্ভিসে প্রতারণা চক্রের মূলহোতা ফজুলল হক আশরাফ ও তার স্ত্রী আছমা আক্তার শিমুকে আটক করা হয়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ প্রতারক এই দম্পতির বিষয়ে জানান, ফজলুল হক ২০১৮ সালে প্রথমে পোস্টাল সার্ভিসের কতিপয় কর্মচারীর সহায়তায় মানি অর্ডারের টাকার পরিমাণ পরিবর্তন করে জালিয়াতি শুরু করে। তিনি নিজেকে পথশিশু ফাউন্ডেশন, সানোয়ার ফাউন্ডেশন এবং এ্যারোলাইট বায়োগ্যাস নামক কতিপয় সংগঠনের প্রধান বলে দাবি করেন।
তিনি পথশিশুদের উন্নয়নের জন্য তাদের দিয়ে কাগজের ঠোংগা বানিয়ে বিক্রয় করে থাকেন বলে জানান। স্বল্পমূল্যে এই কাগজের অব্যাহত সরবরাহের জন্য তিনি প্রথমত সকল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডের চেয়ারম্যানদের নিকট চিঠি দেন। পরবর্তীতে হাইকোর্টে এক রিটের মাধ্যমে সমস্ত শিক্ষাবোর্ড থেকে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রতিটি খাতা ৬০ পয়সা মূল্যে ক্রয় করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন তিনি। সে অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষকদের কাছ থেকে ৬০০ টাকার বিনিময়ে ১০০০ খাতা কেনা শুরু করেন।
তখন থেকেই তিনি জিপিও'র মানি অর্ডার ফরম জাল করে ৬০০ টাকা মূল্যের মানি অর্ডার বিভিন্ন শিক্ষকদের নামে পাঠাতে শুরু করেন। আসল মানি অর্ডারের মতো সই এবং সিল সম্বলিত নকল মানি অর্ডারগুলো কৌশলে জিপিওসহ বিভিন্ন পোস্ট অফিসে বিতরণ, চ্যানেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
এছাড়াও তিনি এ্যারোলাইট বায়োগ্যাস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ই-কমার্সের ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’র আদলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের নিকট তথাকথিত জৈব সার পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। জৈব সার পাঠানোর এই প্রক্রিয়াতে তিনি পোস্টাল সার্ভিসের ভিপি (Value Payable) ব্যবস্থা ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে তিনি জৈব সারের ভূয়া বিক্রি দেখিয়ে তার এ্যারোলাইট বায়োগ্যাসের নামে একই পদ্ধতিতে জাল মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে শুরু করেন। এ প্রক্রিয়ায় তিনি নিজেই মানি অর্ডারের প্রাপক।
প্রতারক ফজলুল অধিক পরিমাণের মানি অর্ডারগুলো সরকারি খামের মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট মাস্টার বরাবর প্রেরণ করতেন। বেশ কিছুদিন পূর্বে তিনি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানাধীন নাগরী পোস্ট অফিস থেকে প্রায় ৪৫০ চিঠি বিভিন্ন পোস্ট মাস্টার বরাবর প্রেরণ করেন। খামের ভেতরে বিভিন্ন অংকের জাল মানি অর্ডার ছিল। প্রতিটা খামে প্রেররেক জায়গায় তিনি নাগরী পোস্ট মাস্টারের সিল ব্যবহার করেন।
পরবর্তীতে নরসিংদী পোস্ট মাস্টারের কাছে পাঠানো খামটি পৌঁছালে তিনি খামগুলো ও মানি অর্ডার দেখে সন্দেহ করেন। কারণ মানি অর্ডার ফরম সাধারণত খামে প্রেরণ করা হয় না। তখন তিনি তার সন্দেহের বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট জানালে তারা তদন্ত করে জানতে পারেন যে, মানি অর্ডারগুলো জাল।
এছাড়াও কৃষকদের সৌদি খেজুর গাছের চারা বিনামূল্যে বিতরণের জন্য সে প্রলোভন দেখান ফজলুল হক। এর অংশ হিসেবে তিনি রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ১০০ টাকা ধার্য করে বিকাশের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠান পথশিশু কল্যাণ ট্রাস্ট এর পক্ষ থেকে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পোস্টাল অর্ডারের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০২১
পিএম/ওএফবি