ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

জোটে না খাবার, করুণায় চলছে বীর মুক্তিযোদ্ধা নসুর জীবন

এ কে এস রোকন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২১
জোটে না খাবার, করুণায় চলছে বীর মুক্তিযোদ্ধা নসুর জীবন নসুরুদ্দিন

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: নসুরুদ্দিন (৬৫)...স্বাধীনতা যুদ্ধের লড়াকু এক সৈনিক। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রের কাছে তার এ সংগ্রামের মূল্য না পেয়ে জীবন যুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক তিনি।

নিজস্ব জায়গা-জমি না থাকায় খাস জমিতে অন্যের করুণায়, অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তিনি। সন্তানেরা দেখভাল না করায় স্ত্রী ভিক্ষা করে যান পান তা দিয়েই কোনো রকমে চলে যাচ্ছে তাদের জীবন।  

নসুরুদ্দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালা ইউনিয়নের বাঘমারা গ্রামে মৃত বাহার আলীর ছেলে। তাকে গ্রামের সবাই নসু নামেই চেনেন। বয়স ৬৫ হলেও চিকিৎসা ও খাদ্যাভাবের কারণে দেখে মনে হবে বয়স ৮০ বছর পেরিয়ে গেছে।  

১৯৭১ সালে পাক হানাদারবাহিনী যখন নিরীহ বাঙালির ওপর নির্মম অত্যাচার চালায় ঠিক তখনই নসু দেশ ও দেশের মানুষকে পাক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। দেশকে মুক্ত করতে পারলেও দেশের কাছে স্বীকৃতি তো দূরের কথা পরাধীন জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাকে।

সরেজমিনে বাঘমারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, খাস জমিতে খুপড়ি ঘর করে সেখানে স্বামী-স্ত্রী থাকেন কোনো রকমে। শুয়ে থাকেন বাঁশের তৈরি অগোছালো একটি বিছানা। শীত নিবারণের জন্য নেই তেমন গরম কাপড়। দীর্ঘদিন অসুস্থতায় ভুগলেও অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে পারেছেন না। তার স্ত্রী নিজেও বয়সের ভারে চলাফেরা করতে না পারলেও এদিক-ওদিক ঘুরে ভিক্ষা করে যা পান তা দিয়েই চলে তাদের সংসার। এই অভাবের সংসারে নিজেদের চিকিৎসা-ওষুধের খরচ বিলাসিতা ছাড়া তাদের কাছে আর কিছুই না। তাদের ৩ সন্তানের মধ্যে একজন শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই থাকেন। অরেক ছেলে পাশের গ্রামে খাস জমিতে দিনমজুরের কাজ করে নিজের সংসার চালান। ছোট ছেলে তাদের সঙ্গে আলাদা একটি খুপড়ি ঘুরে আলাদা সংসার পেতে কোনো রকমে নিজের সংসার চালান।

নসুরুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার সময় হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। তিনি বাংলানিউজকে জানান, দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য জীবনের মায়া ত্যাগ করে ৭ নম্বর সেক্টরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। সাহাপুর মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য তিনি নৌকায় চড়ে যাওয়ার সময় হানাদার বাহিনী তাদের নৌকা লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তখন নৌকায় শুয়ে কোনো মতে প্রাণে বেঁচে তিনি ক্যাম্পে ফেরেন। সেখানে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার পর ইন্ডিয়ার আদমপুর প্রাথমিক ট্রেনিং সেন্টারে ক্যাপ্টেন পানুয়ার কাছে মাসব্যাপী ট্রেনিং করেন। ঘটনাক্রমে রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে তিনি ও তার সহযোদ্ধারা জামবাড়িয়া মাঠে একত্রিত হলে সেখানে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সঙ্গে তারা মিলিত হন। সেখানে তিনি তাদের সবাইকে যুদ্ধের কলাকৌশল শিখিয়ে দেন। যুদ্ধ শেষে আবার তিনি নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। ’

মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি না পাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘হামি মুর্খ-সুর্খ বাপু। হামার কেহু অলদির নাই। যনতে পারিনি কুন্ঠে কি হয়াছে। শুণ্যাছি হাঁর গাঁয়ের অন্য মুক্তিযোদ্ধারা হাঁর লেগ্যা চেষ্টা কর‌্যাছিল। ’

‘কিভাবে জীবন চলছে’ জানতে চাইলে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে তিনি বাংলানিউজকে জানান, দিন তো কারো জন্য আটকে থাকেনা চলে যাবেই।  

তার সহযোদ্ধা হাফিজউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার একসঙ্গে ট্রেনিং ও যুদ্ধ করেছি। নসু কেন মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি পেলনা তা জানি না। নসুর সঙ্গে যারা যুদ্ধ করেছে তাদের অনেকেই মারা গেছেন। আমিসহ ৪-৫ জন সহযোদ্ধা এখন বেঁচে আছি। যারা নসুকে যুদ্ধ করতে দেখেছি। ’

নসুরুদ্দিনের অপর সহযোদ্ধা রিয়াজউদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, নসুর এক স্ত্রী ও ৩ ছেলে। তবে ছেলেরা সবাই বাবাকে ফেলে আলাদা থাকে ছেলেদেরই সংসার ঠিকমতো না চলায় অসুস্থ বাবার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।

নসুরুদ্দিনের সঙ্গে খাসজমিতে থাকা তার ছোট ছেলে হামিদউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, দ্রব্যমূল্যের দামের কারণে তার পরিবারের ৩ জনকে নিয়েই সংসার চালাতে হিমসিম থেতে হয়। বাস করার মতো একটা ভাল ঘরও নেই। তাই বাবা-মায়ের দায়িত্বও নিতে পারিনা।  

চেষ্টা থাকলেও উপায় নেই জানিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তিনি বলেন, ‘দেশের জন্য যুদ্ধ করে বাবার এ অবস্থা কেন?’

এ বিষয়ে ওই উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও বর্তমান চৌডালা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এরফান আলি (চুটু মাস্টার) বাংলানিউজকে বলেন, নসু আমার সঙ্গেই ট্রেনিং ও যুদ্ধ করেছেন। আমি যখন জানতে পারি তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেট ভুক্ত হননি তারপর অনেক চেষ্টা করেও তার স্বীকৃতি এনে দিতে পারিনি। তিনি এখন খুব মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। আমি কমান্ডার থাকাকালে নসুসহ ৭ জনের নাম গেজেট ভুক্ত করার আবেদন জানালে ৪ জন গেজেটভুক্ত হন। বাকি নসুরুদ্দিন, খালেক ও মনিরুল এখনও গেজেটভুক্ত হয়নি। এদের মধ্যে খালেক মারা গেছেন এবং নসুরুদ্দিনের অবস্থা খুবই করুন।  

তিনি আরও বলেন, মূলত মুক্তিবার্তায় এদের নাম না থাকায় গেজেটভুক্ত করা যায়নি। গোমস্তাপুরে যেসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে তাদের বাতিল করে এসব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটভুক্ত করার আবেদন জানায়।

স্থানীয়সহ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই পারে অসুস্থ নসুরুদ্দিনের আত্মত্যাগের মূল্যায়ন করে তার আক্ষেপ মেটাতে ও মানবেতর জীবন থেকে মুক্তি দিতে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২১
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।