ঢাকা: মাত্র ১৫০ টাকা নিয়ে ২০০৮ সালে ঢাকা শহরে এসে অলিতে-গলিতে জুতা পালিশ ও সেলাই করে আজ তিনি লাখ লাখ টাকার মালিক। একটি শো-রুম ও তিনটি গোডাউন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন যশোরের অভয়নগর থানার বাঁশরী গ্রামের বিধান চন্দ্র দাস (৪৫)।
কীভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভয়নগর থানার নোয়াপাড়া ও ফুলতলা হাটে বাবার সঙ্গে কুলিগিরি করতাম। মাঝে মধ্যে বাইসাইকেল চালিয়ে গ্রামে জুতা ও ছাতা শেলাইয়ের কাজ করে বেড়াতাম। বাবা ও আমার রোজগারের টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। কারণ ছোট তিন ভাই এক বোনসহ সংসারে খাওয়ার মানুষ ছিল সাতজন। মনে আছে, কোনোদিন পেট ভরে খেতে দিতে পারতো না আমার মা। যদি আমাদের পেট ভরে খাওয়াতেন তাহলে মা-বাবাকে না খেয়ে থাকতে হতো। তাই একদিন ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম আমাকে পেট ভরে ভাত খাওয়াতে না পারলে আমি আর কাজ করতে যাব না।
‘বাবা-ছেলে মিলে প্রতিদিন যাই রোজগার করতে ছিলাম হঠাৎ একদিন নোয়াপাড়ায় বাসের ছাদে পানের বিড়া উঠাতে গিয়ে পড়ে কোমরের হাড় ভেঙে যায় বাবার। দিশেহারা হয়ে পড়লাম কীভাবে সংসার চালাবো। অসুস্থ বাবার চিকিৎসায় খরচ করে কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না সংসার চালানো। তাই এক বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে ঢাকায় চলে আসি। প্রথমে বনানী ও গুলশান এলাকায় জুতা পালিশ করে বেড়াতাম। সেখান থেকে আস্তে আস্তে গাবতলী এলাকায় চলে আসি। দিন-রাত পরিশ্রম করতে শুরু করি। দিন ও রাতে মাত্র ৮০ টাকার খাবার খেতাম। বাকি পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা জমিয়ে রাখতাম। বাবার চিকিৎসা ও সংসার চালানোর জন্য প্রতি ১৫ দিন পর পর খরচ পাঠাতে লাগলাম বাড়িতে। এভাবেই চলতে থাকে কিছুদিন। বয়স্ক মা বাবার সেবা করার পাশাপাশি সংসারের চাপ কুলাতে পারে না। তাই বিয়ে করে বউকে রেখে আসি গ্রামে। ’
সব ভাই-বোনকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু অভাবের তাড়নায় ও টাকার অভাবে কেউ প্রাইমারি শেষ করতে পারেনি জানিয়ে বিধান বলেন, সব ভাইয়েরা টুকটাক কাজ করতে শিখেছে। বোনটাকেও বিয়ে দিয়েছি। যে যার মতো সংসার করছে। সবাই ভালো আছে। আমিও সৎ পথে রোজগার করে প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছি। বাবার ভিটার পাশে জমি কিনে একতলা বিল্ডিং দিয়েছি। ঢাকা শহরের গাবতলী বড় বাজারে যে শো-রুমটা দেখছেন এর পেছনে অনেক বড় গোডাউন আছে। পাশাপাশি বাসায় আরও ছোট দু’টি গোডাউন আছে। সবই বাবা-মার দোয়া ও সৎ পথে থেকে পরিশ্রমের ফল।
দুই ছেলে এক মেয়ের বাবা বিধান। বড় ছেলে এইচএসসি পাস করেছে। ছোট ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। আর মেয়ে এসএসসি পাস করার পর তাকে লাখ টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছি। বড় ছেলে আর্মির চাকরির জন্য চেষ্টা করছে।
সংগ্রামী এই ব্যবসায়ী বলেন, আমার জীবনের সফলতার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে আমার স্ত্রী কবিতা রানী দাস। বাকি কথা তার কাছ থেকেই শোনেন। কবিতা বলেন, ছোটবেলায় বাবার সংসারে সুখের মুখ দেখিনি। পড়াশোনাও করতে পারিনি। স্বামীর সংসারে এসে শুরু হয়েছে আরেক জীবন যুদ্ধ। পাঁচ বছরেই তিন সন্তানের মা। ছোট ছেলের বয়স যখন তিন বছর তখন তাকে বাড়িতে রেখে ঢাকায় চলে আসি। এসে স্বামীকে সহযোগিতা ও সন্তানদের শিক্ষিত করে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য মিরপুর-১ নম্বর মাজার রোডে মহিলাদের সঙ্গে রাস্তায় মাটির কাজ করেছি। সারা দিনে দেড়শ থেকে দুইশ টাকা রোজগার হতো। তারপর যখন শরীর আর চলে না তখন একটি গার্মেন্টসে অপারেটর হিসেবে কাজ করেছি। দুই বছরে বেতন হয়েছে মাত্র ছয় হাজার টাকা। মাজার রোডে আলীর বস্তিতে দুই হাজার টাকা দিয়ে রুম ভাড়া করে থাকতাম। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গার্মেন্টসে কাজ করে শরীর আর চলছিল না। তখন স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করি, তুমি জুতার কাজ করো আর আমি ঘরের মধ্যে জুতা ও স্যান্ডেল তৈরি করার কিছু মালছামানা এনে বিক্রি করতে চাই। যেমন পরামর্শ তেমনি কাজ। পরের দিন সকালে পুরান ঢাকায় গিয়ে মাত্র ৬০০ টাকা দিয়ে মালছামানা এনে এ দোকান শুরু করি। সেখান থেকে সৎ পথে থেকে ভগবানের ইচ্ছায় ও আপনাদের দোয়ায় আজ এখানে আসতে পেরেছি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২১
জিএমএম/আরবি