রাজশাহী: অসময়ে রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় পদ্মা নদী আগ্রাসী রূপ নিয়েছে। পদ্মার তীব্র ভাঙনে দিশেহারা হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন চরাঞ্চলের মানুষ।
স্কুল, মাদরাসা, মসজিদসহ আরও নানান প্রতিষ্ঠান নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে। ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ রিক্ত ও নিঃস্ব হয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কৃষক, জেলে এবং পেশাজীবী মানুষেরা তার পেশা ও পৈত্রিক ভিটে মাটি হারিয়ে হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। পদ্মা নদীর অসময়ের এই ভাঙনের কবলে পড়ে আত্ম পরিচয়টুকুও হারিয়ে সঙ্গায়িত হচ্ছেন বাস্তুচ্যুত মানুষ হিসেবে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিস্থিতি ভয়াবহ হলেও ভাঙন রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখনও লক্ষ্য করা যায় নি। সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভাঙন কবলিত লোকজন জানান, পদ্মার পানি কমলেও ভাঙনের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। গত তিন মাস ধরেই কম-বেশি পদ্মার ভাঙন চলছে। এতে বিলীন হচ্ছে গাছপালাসহ ফসলি জমি, গ্রাম, সড়ক, ঘরবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গত তিন দশকে ভাঙনের কবলে পড়ে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি, বসত ভিটা, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ ও কবরস্থান।
গত অক্টোবর মাসে ভাঙনের কবলে পড়লে কালিদাশখালি গ্রাম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে চকরাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও পরিষদ সংলগ্ন চেয়ারম্যানের বসতবাড়ি ও কমিউনিটি ক্লিনিক।
ঠিকানা হারানো মানুষগুলো ঘর-বাড়ি গুটিয়ে ছুটছেন এক টুকরো আশ্রয়ের সন্ধানে। এলাকায় বসতি স্থাপনের জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ বাঘা উপজেলার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে চলে গেছেন। আবার কেউ এলাকায় বসতি স্থাপনের জায়গা খুঁজছেন। কিন্তু বর্তমানে জমিতে ফসল থাকায় লিজ নিয়ে ঘর তোলার জায়গাও পাচ্ছেন না। তারা আশ্রয় নিয়েছেন এলাকার নিকটবর্তী আত্মীয়ের বাড়িতে। চরাঞ্চলের নিম্ন এলাকার মানুষ গবাদী পশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন। সঙ্কট দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যেরও।
ভাঙন কবলিত চকরাজাপুর ইউনিয়নের কালিদাসখালী এলাকায় এখন পদ্মা নদীর পাড়ে বসবাসকারী মানুষের আর্তনাদ চোখে পড়ছে। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে পদ্মার চরাঞ্চলের চকরাজাপুর ইউনিয়ন। দীর্ঘদিনের ভাঙনে ইউনিয়নের ৩ ভাগের একভাগ চলে গেছে নদীগর্ভে। পদ্মায় বাড়ি-ভিটে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর মাঝে বিরাজ করছে হাহাকার।
ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে পদ্মার ধারে আরও বসবাসকারী শত শত পরিবার। এই ভাঙনের ভয়ে তারা বর্তমানে বাড়ি-ঘর অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
চকরাজাপুর ইউনিয়নের কালিদাখালী গ্রামের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য শহিদুল ইসলাম জানান, তার ওয়ার্ডে মোট ভোটার সংখ্যা এক হাজার ২৬২ জন। পরিবার ছিল চার শতাধিক। নদী ভাঙনের কারণে ইতোমধ্যে দেড় শতাধিক পরিবার বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। কারও বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে; আবার অনেকেই আগেভাগে সরিয়ে নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। আগামী ২৬ ডিসেম্বর ইউপি নির্বাচন। তিনি এবারও প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু এলাকায় ভোটার অনেক কমে গেছে। যারা এলাকা ছেড়েছেন তাদের খুঁজে পাচ্ছেন না।
ভাঙনে বাড়ি-ঘর হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন চকরাজাপুর ইউনিয়নের রহমত উল্লাহ। এখন সামান্য মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে হন্যে হয়ে ঘুরছেন। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ভাঙনে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বড্ড বিপদে পড়েছি। এলাকায় বসতি স্থাপনের জন্য জায়গা খুঁজছি, কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। সরিয়ে আনা বাড়ির টিনের চালা তুলে আপাতত বড় ভাইয়ের ফসলের জমিতে থাকছি।
পদ্মার ভাঙনের মুখে রয়েছে ষাটোর্ধ্ব রজব মিয়ার বাড়ি। স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসের দুই কিডনি নষ্ট। ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। তিনি বলেন, দুই বছর আগেও আমার বাড়ি থেকে নদী অন্তত দুই কিলোমিটার দূরে ছিল। নদী ভাঙতে ভাঙতে এখন প্রায় তিনশ মিটারে চলে এসেছে। বাড়িঘর নিয়ে কোথায় যাব এ চিন্তা পেয়ে বসেছে। আমি গরিব মানুষ। এলাকায় আমার ছোট চায়ের দোকান থেকে অল্প আয় হয়। বাড়ি ভেঙে গেলে নতুন করে জমি কিনে বাড়ি করার সামর্থ্য নেই। তখন কী করব এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
চকরাজাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মজিবর রহমান বলেন, পদ্মার এই ভাঙন অব্যাহত থাকলে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মানচিত্র থেকে চকরাজাপুর ইউনিয়নই হারিয়ে যাবে। গত বছরের ভাঙনে বিদ্যালয় দুই কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এবছরও ভাঙনের কবলে পড়েছে বিদ্যালয়টি।
পদ্মার ভাঙনের জন্য নদী তলদেশ থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনকেই দায়ী করছেন স্থানীয়রা। লক্ষ্মীনগর গ্রামের মো. রাশেদ বলেন, একদিকে চলছে বালু উত্তোলন, আরেকদিকে ভাঙছে পদ্মা। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ফলে নদী ভাঙন আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে।
চকরাজাপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আজিজুল আযম বলেন, নদী তার গতিতে নিয়মিত ভাঙছে। ইতোমধ্যে আমার বাড়িসহ ইউনিয়ন পরিষদের ভবন ও কমিউনিটি ক্লিনিক অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। শুনেছি উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের আলাইপুর নাপিতপাড়া থেকে চকরাজাপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনগরের শেষ পর্যন্ত নদী শাসনের আওতায় আনার একটি প্রকল্প হয়েছে। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় চরাঞ্চলের সব জায়গা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
জানতে চাইলে রাজশাহীর বাঘা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাভোকেট লায়েব উদ্দীন লাভলু বলেন, আশা করছি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পদ্মার ভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে। চকরাজাপুর ইউনিয়নসহ পাকুড়িয়া ও মনিগ্রাম ইউনিয়নের পদ্মা পাড়ের লোকজন ভাঙন থেকে রক্ষা পাবেন।
আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পাপিয়া সুলতানা বলেন, পদ্মার ভাঙনের বিষয়ে অবগত আছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আলোচনা চলছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০২১
এসএস/এমএমজেড