ঢাকা: নিরাপদ সড়কের দাবিতে ১১ দফা দাবি বাস্তবায়নে শনিবার রামপুরায় সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে লাল কার্ড প্রদর্শন করেছে শিক্ষার্থীরা। রোববার (০৫ ডিসেম্বর) লাল কার্ডের পাশাপাশি সড়কে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিষয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন ও মানববন্ধন করবেন তারা।
শনিবার (৪ ডিসেম্বর) দুপুরে লালকার্ড প্রদর্শনী কর্মসূচি শেষে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন ও মানববন্ধনের এই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
গত ২৯ নভেম্বর রাতে রামপুরায় বাসচাপায় এসএসসি পরীক্ষার্থী মো. মাঈনুদ্দিন নিহতের ঘটনার পর থেকে প্রতিদিনই রামপুরা এলাকায় অবস্থান করছে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানায়, সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষ দুর্নীতিপরায়ন হয়ে উঠেছে। এর ফলে আমরা দেখতে পাই, রাস্তায় ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি এবং অপেশাদার চালক নিয়োগ দেওয়া হয়। গাড়ির চালকরা অনেক কষ্টে দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন-যাপন করেন। তাদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিচ্ছে যারা, তারা দুর্নীতি করছে। তাদের সমস্ত বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করা হবে।
আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা খিলগাঁও মডেল কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া বাংলানিউজকে বলেন, সড়কে যে অব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের চুপ করে বসে থাকা এবং সড়ক ও সড়ক সংশ্লিষ্ট যত দুর্নীতি রযেছে, সব বিষয় আমরা ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরবো।
তিনি বলেন, সড়কে একের পর এক মৃত্যু হচ্ছে, অথচ এ বিষয়ে প্রশাসনের কোনো জোড়ালো ভূমিকা নেই। আসলে পুরো সিস্টেমের দোষ। এই সিস্টেমের মধ্যে ঘুষ, লুটপাটসহ নানা দুর্নীতি রয়েছে।
শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া আরও বলেন, আজ আমরা শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছি। আমাদের ভাই-বোন সড়কে গাড়িচাপায় পিষ্ট হচ্ছে। সড়কের যত অব্যবস্থাপনা রয়েছে সেসবের কারণেই একের পর এক ঘটনা ঘটছেই। আজ সড়কের লুটপাট-দুর্নীতিকে আমরা লাল কার্ড দেখাচ্ছি। আমরা মাঠে ফুটবল খেলার রেফারির ভূমিকা পালন করছি।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে পুলিশ বলছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বহিরাগতরা প্রবেশ করে এই আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নেওয়ার পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীরা বলছে, যদি বহিরাগতরা আমাদের আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নেওয়ার পাঁয়তারা চালায় তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং আমাদের নিরাপত্তা দেবার দায়িত্বটি পুলিশকে নিতে হবে।
এ বিষয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া বলেন, বহিরাগত কারা, তারা কী করছে, সেগুলো আমরা চিহ্নিত করার প্রয়োজনই মনে করছি না। তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে, চালাক। আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো। আমাদের দাবি জনমানুষের কাছে তুলে ধরবো। আমরা চাই নিরাপদ সড়ক, আমরা চাই দুর্নীতিমুক্ত সড়ক ব্যবস্থা। আমি বিশ্বাস করি, জনগণ এখন আমাদের দাবিগুলো নিয়েই ভাবছে।
এর আগে, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের প্রতিযোগিতায় বাসচাপায় নিহত হন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব এবং একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম।
সম্প্রতি রাজধানীর গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান। শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। সড়ক অবরোধ ও আন্দোলন শেষ হতে না হতে সোমবার (২৯ নভেম্বর) দিবাগত রাত পৌনে ১১টার দিকে রামপুরায় অনাবিল পরিবহনের বাসচাপায় আরেক শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়ের মৃত্যু হয়।
গত ২৯ নভেম্বর রাতেই রামপুরা এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতা ৯টি বাস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। মঙ্গলবার সকাল থেকে রামপুরা, ধানমন্ডিসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আবারও আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা।
সেদিন সকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ঘাতক অনাবিল পরিবহনের বাসের হেলপার চান মিয়াকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ ঘটনায় রামপুরা থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে নিহতের মা বাদী হয়ে নিরাপদ সড়ক আইনে একটি মামলা এবং গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের উত্থাপিত ১১টি দাবি হলো—
১. সড়কে নির্মম কাঠামোগত হত্যার শিকার নাঈম ও মাঈনুদ্দিনের হত্যার বিচার করতে হবে। তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গুলিস্তান ও রামপুরা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় পথচারী পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে।
২. সারাদেশে সব গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। হাফ পাসের জন্য কোনো সময় বা দিন নির্ধারণ করে দেওয়া যাবে না। বর্ধিত বাস ভাড়া প্রত্যাহার করতে হবে। সব রুটে বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
৩. গণপরিবহনে ছাত্র-ছাত্রী ও নারীদের অবাধ যাত্রা এবং তাদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৪. ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্সবিহীন চালককে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। গাড়ি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বিআরটিএর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. সব রাস্তায় ট্রাফিক লাইট, জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করাসহ জনবহুল রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. বাসগুলোর মধ্যে বেপরোয়া প্রতিযোগিতা বন্ধে এক রুটে এক বাস এবং দৈনিক আয় সব পরিবহন মালিকের মধ্যে তাদের অংশ অনুযায়ী সমানভাবে বণ্টন করার নিয়ম চালু করতে হবে।
৭. শ্রমিকদের নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র নিশ্চিত করতে হবে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে। চুক্তিভিত্তিতে বাস দেওয়ার বদলে টিকিট ও কাউন্টারের ভিত্তিতে গোটা পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শ্রমিকদের জন্য বিশ্রামাগার ও টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. গাড়ি চালকের কর্মঘণ্টা একনাগারে ৬ ঘণ্টার বেশি হওয়া যাবে না। প্রতিটি বাসে দুজন চালক ও দুজন সহকারী রাখতে হবে। পর্যাপ্ত বাস টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। পরিবহন শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. যাত্রী, পরিবহন শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংস্কার করতে হবে এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
১০. ট্রাক, ময়লার গাড়িসহ অন্যান্য ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে।
১১. মাদকাসক্তি নিরসনে গোটা সমাজজুড়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চালক-সহকারীদের জন্য নিয়মিত ডোপ টেস্টের ও কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, নভেম্বর মাসে দেশে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪১৩ জন এবং আহত হয়েছে ৫৩২ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৬৭ জন এবং শিশু ৫৮ জন এবং শিক্ষার্থী ৫৪ জন। এই সময়ে ঢাকায় ১৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৬ জন।
আরও পড়ুন:
লাল কার্ড হাতে শিক্ষার্থীরা রামপুরার রাস্তায়
রামপুরায় আবারও শিক্ষার্থীদের অবস্থান
বাংলাদেশ সময়: ২০১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০২১
এসজেএ/এমজেএফ