পঞ্চগড়: স্বাধীনতার তীর্থভূমি একাত্তরের মুক্তা অঞ্চল দেশের সর্ব উত্তরের প্রান্তিক উপজেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া। এই উপজেলায় তিনটি ইউনিয়ন ভজনপুর, বুড়াবুড়ি ও দেবনগড় মিলে রয়েছে একটি আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কার্যালয় ও আঞ্চলিক আওয়ামী লীগ কার্যালয়।
ওই কার্যালয়টি প্রায় দুই যুগ (২৪ বছর) ধরে তালাবদ্ধ রয়েছে, নেই কোনো সংস্কারের উদ্যোগ। দীর্ঘদিন থেকে কার্যালয়ে বসতে না পেরে ক্ষুব্ধ স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। যেহেতু তেঁতুলিয়া ছিল হানাদারমুক্ত, পুরো এলাকা ছিল মুক্তা অঞ্চল। তাই এই অফিসে বসে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালের গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও মিটিং করেছেন। স্বাধীনতার তীর্থস্থান ভজনপুরের মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয়টি দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, দেশ স্বাধীনের পর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয়রা ওই অফিসে প্রতিদিন উপস্থিত হতেন ও থাকতো কোলাহল। হঠাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশীয় রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী প্রান্তিক এই উপজেলার ভজনপুরে তাণ্ডব শুরু করে। স্থানীয়দের ঘর-বাড়ি দখল নিয়ে এই অফিসটিও তাদের দখলে রাখার চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু পরে তারা অফিসটি দখলে নিতে ব্যর্থ হয়। আবারও দীর্ঘদিন অবহেলিতভাবে পড়ে থাকে অফিসটি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই অফিসটি অল্প সংস্কার করে। ২০০১ সালে নির্বাচনের আগেই বিএনপি-সমর্থিতরা বন্ধ করে দেয়। ওই সালের নির্বাচনের পর স্থায়ীভাবে অফিসটিতে তালাবদ্ধ করা হলেও সেই তালা আজও খুলেনি।
জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম খাদেম আলী ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে ভজনপুর বাজারে তৎকালীন জাতীয় সড়কের পাশে খাস জমিতে একটি অফিস গড়ে তুলেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হলে ওই অফিসে বসে যুদ্ধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। আর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পুরো তেঁতুলিয়াকে হানাদারমুক্ত রাখতে পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানার চাওয়াই সেতু ও ভজনপুর করতোয়া সেতু ডিনামাইন দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান কিভাবে দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ থাকে এমন প্রশ্নে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রাও।
এখন এই অফিসটি প্রবেশমুখে দুটি চায়ের দোকান স্থাপন করায় এটি তীর্থস্থান নাকি চায়ের স্টোল বোঝাই মুশকিল! কী কারণে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি অফিস বন্ধ রয়েছে তা অনেকেই অজানা।
অফিসটি আগে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা দুই ভাগে সমন্বয়ে ব্যবহার করলেও এখন প্রায় দুই যুগ থেকে কেউ তালা খুলছে না।
স্থানীয়দের দাবি, ওই অফিসের তালা খুলে বসার ব্যবস্থা করাসহ মুক্তিযোদ্ধা কর্নার ও সামনে একটি বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল তৈরি করলে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানবে। তবে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, স্বাধীনতার তীর্থস্থানগুলোতে উন্নায়নের ছোঁয়া লাগেনি ৫০ বছরেও।
পঞ্চগড়ের ইতিহাসে ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন পাক-বাহিনী দখল করে নেয় পঞ্চগড়। জ্বালিয়ে দেয় সাজানো গোছানো পঞ্চগড় শহর এবং হত্যাযজ্ঞ চালায় নির্বিচারে। এছাড়া পাক-হানাদার বাহিনী এদেশীয় রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর সহায়তায় হাজারও নিরস্র জনগণকে হত্যা করে, তাদের ধন-সম্পদ লুটপাট করে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধারা সংঘঠিত হয়ে ও ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাক-বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা ও সন্মুখ লড়াই শুরু করেন।
এই এলাকায় সাতটি কোম্পানির অধীনে ৪০টি মুক্তিযুদ্ধ ইউনিট পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পঞ্চগড় সদর উপজেলার সাতমেরা ইউনিয়ন থেকে পুরো তেঁতুলিয়া উপজেলাকে মুক্তা অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সীমান্ত পরিবেষ্টিত ও ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চগড়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়জুড়ে সংঘটিত হয়েছে ব্যাপক যুদ্ধ। বাংলাদেশে চারটি মুক্তাঞ্চলের মধ্যে পঞ্চগড় মুক্তাঞ্চল যুদ্ধের গতি প্রকৃতি নির্ণয়ে ও পরিকল্পনা প্রণয়নে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখে। ৬ নম্বর সেক্টরের অর্ন্তগত মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি কমান্ডারের মধ্যে মাহবুব আলমের নেতৃত্বে ২৮ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা চার দিক থেকে পাক-বাহিনীর ওপর ঝড়ো আক্রমণ শুরু করে এবং ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় হানাদারমুক্ত হয়।
দেবনগড় ইউনিয়নের আতমাগছ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা সেরাজুল হক বাংলানিউজকে বলেন, এই অফিসটি বন্ধ থাকায় আমাদের দুঃখ লাগে, আমরা মিটিং ও বসার মত একটা অফিস পায় না। কী কারণে এমনটা হয়েছে তা আমরা বলতে পারছি না।
একই ইউনিয়নের পাথরঘাটা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শুকুর আলী বাংলানিউজকে বলেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান এটি। আর এটিকে অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে। আমরা এই অফিসটি চালু করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।
ভজনপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মমতাজ আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমি ছোট থেকে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করি এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আসছি। ভজনপুর এলাকাটি বিএনপি অর্ধশিত। তাই বিএনপি ক্ষমতা থাকা অবস্থায় আওয়ামীলীগ পরিচয় দেওয়া বা সে সময় আওয়ামী লীগ করা খুবই কষ্টের বিষয়। আগে এ এলাকায় হাতে গোনা ১০ জনও আওয়ামী লীগ পরিচয়দানকারি খুঁজে পাওয়া যেতো না। সে সময় থেকে আজও পর্যন্ত আওয়ামী লীগ করে এলেও দীর্ঘদিন ধরে এ অফিসটি তালাবদ্ধ থাকায় আমরা মর্মাহত।
ইউনিয়ন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মনছুর আলী বাংলানিউজকে বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি আসার পর তারা স্থায়ীভাবে অফিসটি বন্ধ করে দেয়। এরপর অফিসটি সেভাবে পড়ে আছে। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু অফিসটি খুলতে পারিনি।
তেঁতুলিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াছিন আলী মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, এই অফিসটার সংস্কার ও উদ্ধার করার জন্য আমাদের যা যা করার দরকার আমরা তা করবো।
তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজি মাহমুদুর রহমান ডাবলু বাংলানিউজকে বলেন, যদি সবার সহযোগিতা পাই তবে, এই অফিসটির আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে পারবো আমরা। একইসঙ্গে ঐতিহ্যবাহী এই অফিসটির উন্নয়নে আমরা সব ধরনের কাজ করবো।
এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এই মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয়টি খোলার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর এই অফিসটি নিয়ে যেকোনো ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয় তা আমাদের জানালে আমরা সেই ব্যবস্থাও নেবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০২১
এএটি