বরিশাল: এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত পাওয়া ৩৬ টি মরদেহের মধ্যে নদী থেকে ৯ টি মরদেহ উদ্ধার করেছে কোষ্টগার্ড। আর বাকিগুলো ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা লঞ্চের ভেতর থেকে উদ্ধার করেছে।
আগুন লাগার পর যারা সাঁতার জানতেন না তার শেষসময়টা পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন লঞ্চে থাকতে। আবার যে ৯ মরদেহ নদী থেকে উদ্ধার হয়েছে তারাও যে সাঁতার জানতেন এমনটাও নয়। আর এসব মানুষের জন্যই তো লঞ্চে লাইফ জ্যাকেট, বয়া, বোট থাকার কথা। যদিও পুড়ে যাওয়া লঞ্চে বয়া থাকার বিষয়টি স্পষ্টভাবেই দেখা গেছে, কারণ সেগুলোও আগুনে পড়ে গেছে। প্রশ্ন উঠেছে এগুলো কেন ব্যবহার হলো না।
যাত্রীদের কেউ কেউ বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়লে কেউ কিছু সঠিকভাবে মাথায় নিতে পারেননি, ফলে বয়াগুলো ব্যবহারের কথা কারো মাথায় আসেনি।
তবে ঢাকা-বরিশাল রুটের সজিব নামের এক যাত্রী জানান, তিনি সাঁতার জানেন না, তারপরেও গত বর্ষায় লঞ্চে যাত্রা করেন। ঢাকায় যাওয়ার পথে বৈরি আবহাওয়ায় মেঘনা নদী উত্তাল থাকায় তিনি ভয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে বয়ার পাশে গিয়ে বসেছিলেন। যদি কিছু হয় তাহলে বয়া নিয়ে নদীতে ভেসে থাকবেন এ চিন্তা করে।
সজিবের মতে, তার মতো যারা সাঁতার জানেন না তাদের সবার মাথাতেই এমন চিন্তা আসবে, আর এটাই স্বাভাবিক।
তাহলে বয়াগুলোর সমস্যা কি ছিল?
ওই রাতে এই লঞ্চে থাকা নারী যাত্রী রিনা বেগম জানান, তার ১৩ বছরের সন্তান সাঁতার জানতেন না, কিন্তু আগুনের ভয়াবহতা দেখে তাকে লঞ্চ থেকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেন তিনি। আর সন্তানের মাথা ভাসতে দেখে তিনিও লাফ দেন এবং দুজনেই বেঁচে তীরে উঠতে সক্ষম হন।
রিনা বেগমের কাছে প্রশ্ন ছিল- লঞ্চের নিচ তলার ডেকে তো পর্যাপ্ত বয়া ছিলো তাহলে সেগুলোর ব্যবহার কেন করলেন না?
উত্তরে তিনি বলেন, আমি যে উচ্চতার মানুষ তার থেকেও অনেক ওপরে রাখা ছিলো বয়াগুলো। সেগুলো আমার পক্ষে নামানো সম্ভব ছিল না।
এ লঞ্চে নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজতে আসা বরগুনা সদরের বাসিন্দা সুমনের অভিযোগ আর কতটা ওপরে থাকলে বয়াগুলো যাত্রীরা হাতে পেতো।
তিনি বলেন, আমার স্ত্রী-দুই কন্যা ও শ্যালকের ছেলে নিখোঁজ রয়েছে। যারমধ্যে দুজন শিশু সন্তান এবং তারা সাঁতার জানেন না। তাদের কারও কোন খোঁজ পাচ্ছি না, সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
লঞ্চে স্বজনহারাদের অভিযোগ যাচাই করতে গিয়ে পুড়ে যাওয়া লঞ্চের ডেকে গিয়ে দেখাগুলো ছাঁদের কিছুটা নিচে লোহার র্যাকে সারিবদ্ধভাবে রাখা বয়াগুলো আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও এর সবগুলোই সারিবদ্ধভাবে সাজানোও আছে। তবে এগুলো সাধারণ উচ্চতার মানুষদের পক্ষে নিচে নামানো সম্ভব নয়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যাত্রী কালু মিয়া বলেন, লঞ্চে আগুন লাগার পর আগুন আর ধোঁয়ায় ওপরের দিকে কিছুই দেখা যায়নি, সেক্ষেত্রে বয়াগুলো আসলে কারো চোখেই পরেনি। পাশে রাখা থাকলে তাও দুএকজন হাতে নিয়ে নদীতে লাফ দিয়ে বাঁচতে পারতো। যারা লঞ্চ থেকে লাফাতে পারেননি তাদের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিল হয়তো হাতে গোনা কয়েকজন, কারন অন্য যাত্রীদের চিৎকারে কারো ঘুমিয়ে থাকা সম্ভব না।
তিনি বলেন, যারা সাঁতার জানতেন না, তারাই নদীতে লাফ দিতে সাহস করেননি। আবার সাঁতার না জানা অনেকেই লাফ দিয়েও শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেননি।
আর নদী থেকে উদ্ধার হওয়া মরদেহগুলোর বেশিরভাগেরই পায়ে আগুনে ঝলছে যাওয়ার ক্ষত রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন বরিশাল কোস্টগার্ড স্টেশন কমান্ডার লেফট্যানেন্ট আহম্মেদ অনাবিল।
এদিকে বাংলাদেশ কার্গো ট্রলার বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়নের ঝালকাঠি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের চিৎকার শুনে আমরা যখন উদ্ধারে যাই, তখন প্রথমে শুধু যারা পানিতে ভাসছিলো তাদের উদ্ধার করেছি। আর সেসব যাত্রীরাই বলেছেন বহু মানুষ ঝাপ দিয়েছেন, যারা সাঁতার জানতেন না তারা তলিয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে লাইফ বয়ায় হয়তো এদের প্রাণ বাঁচতো।
আর জীবন রক্ষাকারী সামগ্রীর ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এগুলো যে সহজভাবে দৃশ্যমান জায়গায় রাখার বিধান রয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তরা।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬,২০২১
এমএস/এনএইচআর