ঢাকা: সম্প্রতি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার প্রতিকার করতে 'নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটি থেকে কেন্দ্র ও জেলা কমিটির সমন্বয়ে ৪৮টি সুপারিশ করা হয়।
সোমবার (২৮ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারর্স ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত জাতীয় কনভেনশনে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটি এই সুপারিশ পেশ করেন।
এসময় নেতৃবৃন্দ নারীর বিরুদ্ধে সামাজিক অনাচার রুখে দিতে বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তোলার কথা বলেন। বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সফলতার কথা তুলে ধরেন তারা। নারীর মানবাধিকার রক্ষা এবং নারী নির্যাতন বন্ধে সরকারের অঙ্গীকার পূরণে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে সরকারকে ভূমিকা রাখার আহ্বান করেন নেতৃবৃন্দ। নারীর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধ ও প্রতিকারে গ্রহণ করা হয় ইতিবাচক পদক্ষেপ।
নারী নির্যাতন ও সহিংসতা প্রতিরোধে কেন্দ্র ও জেলা শাখার নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ কমিটির সদস্যবৃন্দ মতবিনিময় সভায় যে ৪৮ সুপারিশ করেন তা হলো-
১. পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন করতে হবে। পরিবারে নারী-পুরুষের সমতার বিষয় চর্চা করতে হবে।
৩. নারীকে সম্মান করা ছেলেদের শেখানো, তরুণদের উদ্বুদ্ধ করা, মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৪. নারী নির্যাতন বন্ধে রাষ্ট্রের কঠোর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।
৫. নারী ও কন্যা নির্যাতনকারীদের বিচারের আওতায় আনাসহ আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
আইনের মাধ্যমে অপরাধীদের দণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সংশোধনের বিষয়ে মানসিকতা পরিবর্তনের গুরুত্ব দিতে হবে।
৭. মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের জেন্ডার সংবেদনশীলতা বাড়াতে হবে।
৮. ধর্ষকের সঙ্গে নির্যাতিতা নারীর বিয়ে দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
৯. নির্যাতিতা নারী নয়, ধর্ষককে প্রমাণ করতে হবে যে সে ধর্ষণ করেনি মর্মে আইনের বিধান হতে হবে।
১০. সাইবার ক্রাইম বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
১১. নারীদের অভিযোগ গ্রহণের জন্য সব থানায় আলাদা হেল্প ডেস্ক থাকতে হবে।
১২. বৈষম্যমূলক আইন পরিবর্তন করতে হবে।
১৩. নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিত করাসহ সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।
১৪. সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যার সব পর্যায়ে নিরাপত্তা, নিরাপদ আশ্রয়, ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
১৫. নারীর মানবাধিকার সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করাসহ বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
১৬. হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে এবং রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
১৭. নারী নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে।
১৮. যৌন নিপীড়ক ও ধর্ষককে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বয়কটসহ আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
১৯. নারী নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রশাসনিক আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
২০. ধর্ষকদের নিয়ে গবেষণা করে ধর্ষণের মূল কারণসমূহ অনুসন্ধান করতে হবে।
২১. নারী নির্যাতনের সংস্কৃতিকে সমর্থন করে, এমন সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ পরিবর্তনের লক্ষ্যে জাতীয় নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
২২. সংবিধানে বর্ণিত সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
২৩. প্রান্তিক নারীদের সঙ্গে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করতে হবে।
২৪, রাস্তাঘাটে নারী ও কন্যার নিরাপদ যাতায়াতের জন্য পরিবহন মালিক সমিতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে।
২৫. পাঠ্যসূচিতে জেন্ডার ধারণার বিষয় যুক্ত করতে হবে।
২৬. মাদকের বিস্তার রোধসহ মাদক চোরাচালানকারী ও সরবরাহকারী মূল হোতাদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
২৭. নারী ও কন্যা নির্যাতন প্রতিরোধ ও নির্মূলে গবেষণা করে সুপারিশ তৈরিসহ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
২৮. সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেম, মানবাধিকার, মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিষয় পাঠ্যসূচিতে রাখতে হবে।
২৯. নারী ও কন্যার মর্যাদা, নারীকে সম্মান করা, নারীর প্রতি বৈষম্য এবং সহিংসতা প্রতিরোধের বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৩০. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৩১. ছেলেদের স্কুল-কলেজগুলোতে নারী ও কন্যা নির্যাতনবিরোধী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
৩২. নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে পারিবারিক, সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোসহ ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
৩৩. নারী ও কন্যা নির্যাতন বন্ধে প্রত্যেক জেলার এসিসি এবং থানায় হেল্প ডেস্কের সঙ্গে আন্তঃসমন্বয় বাড়াতে হবে।
৩৪. নারী নির্যাতন প্রতিরোধে জেলা কমিটি, উপজেলা কমিটি ও ইউনিয়ন কমিটিগুলোকে সক্রিয় করতে হবে।
৩৫. ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, হত্যা, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন, যৌতুক, বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
৩৬. জাতীয় বাজেটে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৩৭. গৃহশ্রমের সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৩৮. নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করতে হবে।
৩৯. নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসহ সব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
৪০. জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার বাস্তবায়ন করতে হবে।
৪১. সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
৪২. সংসদে এক তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ এবং সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪৩. সিডও সনদের ধারা-২ এবং ১৬(১)(গ) ধারা থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করতে হবে।
৪৪. নারী ও কন্যা নির্যাতন বন্ধে সরকার, বেসরকারি সংগঠন, নাগরিক সমাজ এবং নারী আন্দোলনের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৪৫. নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে রাষ্ট্রের ভূমিকার পাশাপাশি সামাজিক পরিবারকে ভূমিকা রাখতে হবে।
৪৬. সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় সঠিকভাবে মামলা দায়েরসহ সহিংসতার সঙ্গে যুক্তদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৪৭. সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
৪৮. যেখানেই নারী ও কন্যা নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সামাজিক অনাচার সেখানেই সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
জাতীয় কনভেনশনে ২০২১ সালে প্রাকাশিত মহিলা পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়। যেখানে বলা হয়, ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, এই সময়ে ৮১০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আর এই সময়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২২৫টি, এছাড়া ধর্ষণচেষ্টা হয় ১৯২টি। অন্যদিকে উত্ত্যক্ত করা ও যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটেছে ৯৬টি।
জাতিসংঘের বিশেষ রিপোর্ট এর মতে, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে স্বামী কিংবা তার পরিবার বা উভয়ের দ্বারা নির্যাতিত হন।
এছাড়া প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০২২ সালে অক্টোবর পর্যন্ত ২০৫টি দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালে ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৭টি, কিন্তু ২০২২ সালে জানুয়ারি-আগস্ট এই ৮ মাসের মধ্যেই ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৭টি। ২০২১ সালে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ৪৫ জনকে আর ২০২২ সালে অক্টোবর পর্যন্ত যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জনকে। এসব ক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইম বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে নারী ও কন্যারা ভার্চ্যুয়ালি যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানীত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. কাবেরী গায়েন।
মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ব্যারিস্টার একে রাশেদুল হক অমিত। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম। জাতীয় কনভেনশনে ৪২টি জেলা থেকে অতিথিরা অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০২২
এসআর/আরএ