ঢাকা: এপ্রিল মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদনে চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে এনে বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে। বিশ্বব্যাংক গত জানুয়ারি মাসে তাদের পূর্বাভাসে বলেছিল, চলতি অর্থবছরে ৪ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।
দেশে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গণবিক্ষোভ, কারফিউ এবং ইন্টারনেট বন্ধ থাকার মতো অনভিপ্রেত ঘটনার মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) হয়েছে মাত্র ১০৪ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এফডিআই ছিল ৩৬০ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার।
এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এপ্রিল মাসের ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের উল্লেখ টেনে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের চড়া হারের কারণে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন, যার ফলে প্রবৃদ্ধির গতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চিত নীতিকাঠামো, ব্যাংকের উচ্চ সুদহার এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যযুদ্ধের মিলিত প্রভাবে চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট সময় পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বেসরকারি বিনিয়োগ ও এফডিআই সীমিত থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫ শীর্ষক বিনিয়োগ সম্মেলনে বিশ্বের সামনে একটি দ্রুত বর্ধনশীল ও বিনিয়োগের সুযোগপূর্ণ অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ইতিবাচক ও শক্তিশালী ভাবমূর্তি তুলে ধরা হয়, যা বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মাঝে বহু দিন ধরে চলে আসা নেতিবাচক ধারণাগুলো পাল্টে দিয়ে দেশের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা করতে সহায়ক হবে। অর্থনৈতিক রূপান্তরে বিদেশি বিনিয়োগের ভূমিকা : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরে বেসরকারি খাত, বিশেষত রপ্তানিনির্ভর তৈরি পোশাকশিল্প উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। কৃষি খাতের বাইরে আধুনিক শিল্প ও সেবা খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, গার্হস্থ্য ভোগব্যয় বৃদ্ধি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্ফুরণ ও বিকাশের ফলে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ আকর্ষণীয় একটি বাজার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আসে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান, নেদারল্যান্ডস, হংকং, নরওয়ে, ভারত ও মালয়েশিয়া থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বাধিক ৪৩৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে টেক্সটাইল ও পোশাক খাতে। ব্যাংকিং খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। অন্যান্য খাতের মধ্যে ওষুধ ও রাসায়নিক, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রোলিয়ম এবং খাদ্য খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে। সেমি-কন্ডাক্টর, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং বঙ্গোপসাগরভিত্তিক ব্লু ইকোনমি খাতে এফডিআই আকর্ষণ করার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।
২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হলে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে অগ্রাধিকারমূলক শুল্কমুক্ত সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে, যার পরিপ্রেক্ষিতে রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা এবং শিল্পায়নের জন্য সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এফডিআই বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক রূপান্তরে এফডিআই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। গত শতকের আশির দশকের পরবর্তী সময়ে চীন, মেক্সিকো, ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে এফডিআই খুবই সহায়ক হয়েছে।
শিল্প খাত, বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি ও জ্ঞান স্থানান্তর এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে এফডিআই সহায়ক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি গন্তব্য হিসেবে গণ্য হলেও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। বিশ্বব্যাংক, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) বিভিন্ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম বাধা হলো দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। পাশাপাশি, উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রয়েছে করনীতি, শুল্কছাড় ও মুনাফা প্রত্যাবাসনের বিষয়।
বাংলাদেশে বন্দর ব্যবস্থাপনা এখনো আশানুরূপ উন্নত হয়নি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পেলে বন্দর ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে টেকসই জ্বালানি সরবরাহ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ উদ্বেগের কারণ। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগের আরেকটি কারণ আকস্মিক নীতি পরিবর্তন। বছরে বছরে সরকারি নীতি পরিবর্তন হলে ব্যবসার মুনাফায় প্রভাব পড়ে, যা ব্যবসায় অনিশ্চয়তা তৈরি করে এবং বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কঠিন হয়ে ওঠে। কার্যত দেখা যায়, প্রায় প্রতি অর্থবছরে সরকার করনীতি পরিবর্তন করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায়।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। সম্মেলনে প্রায় ৫০টি দেশ থেকে ৪১৫ জন বিদেশি প্রতিনিধি যোগদান করেন, যার মধ্যে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে সর্বাধিক সংখ্যক প্রতিনিধি উপস্থিত হন। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক স্থানীয় উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সম্মেলনে যোগদান করেন। সরকারের বিনিয়োগবান্ধব নীতি ও অবকাঠামো উন্নয়নের হালনাগাদ চিত্র বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের সামনে তুলে ধরা হয়। রিনিউয়েবল এনার্জি, ডিজিটাল ইকোনমি, বস্ত্র ও পোশাক, স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে সম্মেলনে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫ চলাকালীন প্রায় ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা সমমূল্যের প্রাথমিক বিনিয়োগ প্রস্তাবনা এসেছে। এ ছাড়া সম্মেলনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সমঝোতা স্মারকের মধ্যে নাসার আর্টেমিস অ্যাকর্ডসে বাংলাদেশের যোগদান যুগান্তকারী এক সাফল্য, যার পরিপ্রেক্ষিতে মহাকাশ অনুসন্ধানে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। সোলার পাওয়ার ইউরোপ ও বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির পাশাপাশি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এমওইউ বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে।
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ দরকার : এফডিআই আকর্ষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অবস্থানের দিক দিয়ে সমপর্যায়ের এবং রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় দীর্ঘদিন যাবৎ পিছিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বে এফডিআই প্রবাহের দিক দিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলন (আংকটাড) কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এফডিআই প্রবাহ জিডিপির তুলনায় মাত্র ০.৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে মালদ্বীপে ২০২২ সালে জিডিপির তুলনায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ১১.৭০ শতাংশ। শ্রীলঙ্কা ২০২২ সালে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে, তবু দেশটি জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ২০ শতাংশ এফডিআই আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
এফডিআই ভৌত মূলধন গঠন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তিজ্ঞান স্থানান্তর ও অর্থনীতিকে বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে সহায়ক। দেশে অভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি সব অংশীজনের সমন্বিত ও সক্রিয় উদ্যোগ দরকার। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার প্রধান উপাদান সস্তা শ্রম। ভবিষ্যতে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করে এফডিআই আকর্ষণ করার উদ্যোগ থেকে সরে অর্থনীতির বৈচিত্র্যকরণ, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ, দক্ষ জনবল তৈরি ও উদ্ভাবনার প্রতি অগ্রাধিকার বাড়ানোর দরকার হবে।
২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলো যথাযথ সমাধা করে উন্নয়নশীল অর্থনীতির সুযোগগুলো কাজে লাগানোর লক্ষ্যে বিস্তারিত ও অগ্রসর কৌশল গ্রহণ প্রয়োজন। প্রধান অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সক্রিয়ভাবে আলোচনা করা, আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী রপ্তানি পণ্যের মান উন্নত করা, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের ক্ষেত্রে উচ্চমূল্যের খাতগুলোর প্রতি অগ্রাধিকার বাড়ানো ও রিনিউয়েবল এনার্জি, ডিজিটাল ইকোনমি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণের মতো সম্ভাবনাময় খাতে এফডিআই আকর্ষণ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির গতি জোরদার হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী, নীতিনির্ধারক, একাডেমিয়া এবং অন্য অংশীজনদের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ ও অংশীদারত্ব তৈরি করা ফলপ্রদ হবে।
লেখক : ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি বিশ্লেষক
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন