ঢাকা, বুধবার, ৫ ভাদ্র ১৪৩২, ২০ আগস্ট ২০২৫, ২৫ সফর ১৪৪৭

মুক্তমত

প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দৃঢ়চিত্ত ড. ইউনূস

অদিতি করিম। সৌজন্য: কালের কণ্ঠ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৪৫, আগস্ট ২০, ২০২৫
প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দৃঢ়চিত্ত ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তিনি শুধু বাংলাদেশের নন, সারা বিশ্বের একজন রোল মডেল। জাতির প্রয়োজনে, জাতির এক মহা সংকটে তিনি দেশের হাল ধরেছিলেন।

তিনি সাম্প্রতিক সময়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি দায়িত্ব নিইনি। জনগণ আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। ’ 

বাস্তবই তাই। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের আপামর জনগণ দল-মত-নির্বিশেষে সম্মিলিতভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অভিষিক্ত করে। তাঁকে নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। তিনি স্বতঃস্ফূর্ত জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আর কোনো সরকারপ্রধান দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর শুধু প্রধান উপদেষ্টাই হননি, বরং তিনি ছিলেন জাতির কাণ্ডারি। সত্যিকারের অভিভাবক।

দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের ফলে বাংলাদেশ হয়েছিল পথহারা, দিগভ্রান্ত।

ফ্যাসিবাদের পতনের পর মানুষ ছিল দিশাহারা। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের লুণ্ঠনতন্ত্রের কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল ভঙ্গুর। কূটনৈতিক অবস্থা ছিল পরনির্ভর। কোনো ক্ষেত্রেই আমাদের কোনো সাফল্য ছিল না। এ রকম একটি ক্রান্তিকালে তিনি দেশের দায়িত্ব নেন।

ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধার করার জন্য যেমন সাহসী নাবিকের প্রয়োজন হয়, তেমনি দিগভ্রান্ত, দিশাহারা বাংলাদেশকে উদ্ধারের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কোনো বিকল্প ছিল না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর সারা বিশ্ব আনন্দিত হয়, স্বস্তি প্রকাশ করে। বিশ্বের ৯২টি দেশের সরকার, রাষ্ট্রপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশে ইতিহাসে আর কখনো কোনো সরকারপ্রধান দায়িত্ব গ্রহণের পর এভাবে বিশ্বের অভিনন্দন পাননি, বিশ্বের সমর্থন পাননি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেলজয়ী। আর এ কারণে বিশ্বজুড়ে তাঁর রয়েছে আলাদা সুনাম ও খ্যাতি। সেই সুনাম ও খ্যাতিকে তিনি বাংলাদেশ পুনর্গঠনে কাজে লাগিয়েছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সারা বিশ্বের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তাঁর জ্ঞান, দর্শন, চিন্তা-ভাবনা বিশ্বকে আলোকিত করেছে। বিশেষ করে তরুণসমাজকে আলোকিত করেছে। সেই জ্ঞান ও বিচক্ষণতা দিয়ে তিনি যেন গত এক বছর বাংলাদেশকে আলোর পথে নিয়ে যাচ্ছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সবচেয়ে বড় গুণ হলো—তিনি দায়িত্ব নেন এবং হাসিমুখে দায়িত্ব পালন করেন। কঠোর পরিশ্রম করেন। তাঁর ক্লান্তি নেই। প্রতিদানে তিনি কিছু প্রত্যাশা করেন না। আমরা দেখেছি, ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করছেন। ব্যাংকিং সেক্টরে তিনি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছেন। বাংলাদেশে যে দুর্নীতি ও লুটপাট কায়েম হয়েছিল, সেখান থেকে দেশে একটি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। সামগ্রিকভাবে দেশকে একটি সঠিক পথে গত এক বছরে তিনি নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। এটিই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কৃতিত্ব।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, গত এক বছরের বেশি সময় তাঁর কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ দেখাননি। বরং তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন—রাজনীতি করার জন্য নয়, দেশের মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আর সে কারণেই ড. ইউনূসের প্রতি জনগণের এখন আলাদা শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি কেবল অর্থনীতিই পুনরুদ্ধার করেননি। রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে পচন ধরেছিল, সেই পচন থেকে মুক্তির পথ তৈরি করেছেন। রাষ্ট্র মেরামতের সুনির্দিষ্ট রূপকল্প তৈরি করেছেন। তিনি বেশ কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের সংস্কার না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা আবার নতুন করে কায়েম হবে। এ কারণেই রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টিকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নিয়েছেন। রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে তিনি নতুন একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণের ভিত্তি রচনা করেছেন, যেটি নির্বাচিত সরকার নিশ্চয়ই বাস্তবায়ন করবে।

এই সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের সুনাম বাড়িয়েছেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশ বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর কারণেই জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস বাংলাদেশে বসছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে এবং বাংলাদেশের এই চলমান সংস্কার ও পুনর্গঠনে তাঁরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিরঙ্কুশ সমর্থন জানিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কারণেই।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চান না। ক্ষমতার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ নেই, লোভও নেই। আর এ কারণেই দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি বলেছিলেন, ‘সংস্কার ও বিচারপ্রক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিয়ে তিনি নির্বাচন করবেন। ’ ড. ইউনূস তাঁর কথা রেখেছেন। তিনি নির্বাচনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বছর পূর্তিতেই তিনি জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন পরিস্থিতি যত প্রতিকূলই হোক না কেন, তিনি তাঁর কথা রাখেন। এই অঙ্গীকার পূরণের জন্যই তিনি আজকে এ রকম একটি সম্মানিত জায়গায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। বিশ্বে তিনি এ কারণেই এত সম্মানিত।

দেশে এখন নির্বাচনের আমেজ তৈরি হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনবিরোধী শক্তিও সক্রিয়। নানা রকম কারসাজি করতে চাইছে, নানা রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইছে এবং নানা রকম ইস্যু সামনে এনে নির্বাচনের পথকে বন্ধুর করতে চাইছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিপ্রিয়, কিন্তু দৃঢ় আদর্শবাদী ব্যক্তিত্ব। তিনি তাঁর অবস্থান থেকে পেছাবেন না যত প্রতিকূল পরিবেশই থাকুক।

আমরা জানি, নির্বাচনের জন্য আর ছয় মাসেরও কম সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান অত্যন্ত দুরূহ কাজ। কিন্তু ড. ইউনূস আছেন বলেই মানুষ আশান্বিত। তিনি যেমন কথা দিয়েছিলেন যে তাঁর কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই, তিনি একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাবেন, লন্ডনে তিনি যেমন বলেছিলেন যে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করবেন—প্রতিটি কথা তিনি রেখেছেন। নির্বাচন কমিশনকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। আমরা আশা করি, ড. ইউনূস যেমনটি বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন হবে আগামী নির্বাচন, সেই কথাটিও তিনি রাখবেন। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন কাজ শুরু করেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করা হয়, সে জন্য সব কিছু করার কাজ শুরু করেছেন তিনি। নিশ্চয়ই ড. মুহাম্মদ ইউনূস সফল হবেন। সব প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করে তিনি বাংলাদেশের মাটিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবেন।

আমরা জানি, কোনো কোনো মহল এখন নির্বাচন নিয়ে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে চাইছে। কিন্তু একটি কথা মনে রাখতে হবে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। কাজেই সবাই আশা করে, রাজনৈতিক দলগুলো যতই নিজেদের মধ্যে বিরোধ করুক না কেন, জুলাই সনদ বা অন্যান্য ইস্যু নিয়ে যতই তাদের মধ্যে মন-কষাকষি বা বিতর্ক থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত তারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা শুনবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসে যেভাবে তাদের পরামর্শ দেবেন, সেভাবে তারা অবশ্যই কাজ করবে। কারণ সব রাজনৈতিক দলের একটি বিষয় স্পষ্ট যে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকতে পারে, তাদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু একটি বিষয়ে সবাই একমত, তা হলো—ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাদের সত্যিকারের অভিভাবক।

কাজেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন চেয়েছেন যে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তখন শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যের পতাকাতলে আসবে এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশে শান্তি স্থাপনের মিশন সম্পন্ন করবেন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে, যে নির্বাচন মানুষ যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই নির্বাচন নিয়ে গর্ব করবে এবং বাংলাদেশ পরিপূর্ণ ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়ে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও পরমতসহিষ্ণুতার এক নতুন বাংলাদেশের সূচনা করবে।  

অদিতি করিম : নাট্যকার ও কলাম লেখক

ই-মেইল: auditekarim@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।