গত ১৬ বছর বাংলাদেশ শুধু দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ ছিল না- ছিল একটি দমবন্ধ, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র। মানুষ কথা বলতে পারত না, চোখ তুলে তাকাতে পারত না, এমনকি বিশ্বাস করত না যে জনগণই রাষ্ট্রের মালিক।
আমি ছিলাম সেই কারাগারের এক প্রতিবাদী বন্দি। শুধু মত প্রকাশের অপরাধে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্যায়ভাবে অপসারণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রদ্রোহসহ অগণিত কাল্পনিক মামলার বোঝা নিয়ে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়। যেদিন আমার বাসা থেকে উচ্ছেদ করা হয়, সেদিন আমার ক্যানসার আক্রান্ত স্ত্রী কাঁদছিলেন, আর আমাদের মেয়ে জানালা দিয়ে নির্বাক তাকিয়ে ছিল।
সেই বিশ্ববিদ্যালয় আবার জেগে উঠেছিল। কিন্তু আমি, একজন নির্বাসিত শিক্ষক, দূর থেকে অনুভব করছিলাম- এই জাগরণ কেবল ছাত্রদের নয়, আমারও এক ধরনের পুনর্জন্ম। খবরে, ভিডিওতে, ছাত্রদের মুখে শুনছিলাম- টিএসসিতে কিছু ছাত্র দাঁড়িয়ে গেছে নিঃশব্দে। কারও হাতে লেখা পোস্টার : ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ এই একটি বাক্যে যেন সারা দেশের হতাশা, জ্বালা, আশা- সবকিছু মিশে ছিল।
৪ জুলাই, যখন আপিল বিভাগ কোটা বহাল রাখেন, তখন ছাত্রদের চোখে যে রাগ আর আত্মবিশ্বাস দেখলাম- তা যেন আমার নিজের দৃষ্টিতে ফিরে এলো। ‘বাংলা অবরোধ’ নামে এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধের বিস্ফোরণ ঘটল। আমি বহু অবরোধ দেখেছি, কিন্তু এবারকার প্ল্যাকার্ড, দেয়াল লিখন, মুখের স্লোগান, চোখের ভাষা- সব ছিল ভিন্ন। তারা বলছিল, ‘কোটা না মেধা- মেধা, মেধা’, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম- এই লড়াই কেবল কোটাবিরোধী নয়, এটি এক লাঞ্ছিত প্রজন্মের আত্মমর্যাদা উদ্ধারের আন্দোলন। এক যুগের বেশি জনগণের ভোটাধিকার ডাকাতি করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ৭ জুলাই বলেন : ‘এই আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। ’ আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। চারদিকে স্লোগান, রাজপথে ছাত্রদের চোখে প্রতিজ্ঞা, শহীদ মিনারে মানুষের ঢল- আর তিনি বলছেন অযৌক্তিক?
১৪ জুলাই শেখ হাসিনা বলেন- ‘যারা কোটা নিয়ে আন্দোলন করছে, তারা রাজাকারদের নতি-পুতি। ’ অপমানের শিকার হলো দেশের সবচেয়ে মেধাবী, সাহসী আর সংবেদনশীল প্রজন্ম। একজন অবৈধ শাসক জাতির সন্তানদের বিরুদ্ধে ছুড়ে দিলেন চরিত্রহননের ঘৃণ্য অপবাদ। বিগত বছরগুলোতে বহুবার আমাকে শুনতে হয়েছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘গণদুশমন’। কিন্তু এবার দেখলাম, একটি সম্পূর্ণ প্রজন্মকে একযোগে রাজাকার বলা হলো- শুধু তাদের ন্যায্য দাবির কারণে। এ কথার প্রতিক্রিয়া ছিল সর্বব্যাপী, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে ধ্বনিত হচ্ছিল নতুন স্লোগান : ‘তুমি কে, আমি কে- রাজাকার, রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে- স্বৈরাচার, স্বৈরাচার!’ এই বাক্যগুলোই হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ- এক বিপন্ন প্রজন্মের কণ্ঠস্বর, যাকে রাষ্ট্র চেপে রাখতে চেয়েছিল।
১৫ জুলাই দুপুরে শুরু হয় দমনযজ্ঞ- নেমে আসে রাষ্ট্রের বাহিনী ও ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের ওপর গরম পানি নিক্ষেপ করা হয়, ছেলেদের মাথা ফাটানো হয় লোহার রড দিয়ে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মুখে কাপড় বেঁধে, হাতে অস্ত্র নিয়ে ঘুরছিল- যেন রাজপথে বিচরণ করে বেড়ানো একদল হায়েনা। তারা ঢুকে পড়ে হাসপাতালে- অসহায় চিকিৎসাধীন আহত শিক্ষার্থীদের আবারও আঘাত করে। একজন আহত ছাত্রী রক্তাক্ত মুখে বলেছিল : ‘সুস্থ হয়েই আবার যাব মিছিলে, আমার দাবি ছাড়ব না। ’ আমি বুঝলাম, ইতিহাস বদলে যাচ্ছে।
১৬ জুলাই দুপুরে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একটি ভিডিও। একজন ছাত্র- বুক চিতিয়ে, দুই হাত তুলে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সেই নিরস্ত্র ছাত্রকে পুলিশ সরাসরি গুলি করে হত্যা করে। তার নাম আবু সাঈদ। বয়স ২৩। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র- কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। সে ছিল মিছিলের সামনের সারিতে।
সেদিন বিকালে সারা দেশে গর্জে ওঠে ছাত্রসমাজ। আকাশের দিকে উঠে মুষ্টিবদ্ধ হাত। তারা শুধু স্লোগান দেয়নি- তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। অসীম সাহসী, টগবগে তরুণরা সারা দেশে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, হেলমেট লীগের গুলিতে নিহত হয়। চট্টগ্রামে শহীদ হয় ওয়াসিম। প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত হলগুলো দখল করতে শুরু করে। আমি দেখলাম, যে সংগ্রামের জন্য আমাকে শিক্ষকতা হারাতে হয়েছে, মামলা খেতে হয়েছে, পরিচয় হারাতে হয়েছে- আজকের প্রজন্ম সেই সংগ্রামকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। আমি হারিয়ে যাইনি- আমার উত্তরসূরিরা যুদ্ধ করছে, বুক ফুলিয়ে, চোখ তুলে।
পরদিন সকাল থেকে দেশজুড়ে হয় গায়েবানা জানাজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম- প্রত্যেকটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা কালো ব্যানার হাতে, মাথায় কালো কাপড় বেঁধে জড়ো হয়। চারদিক থেকে প্রতিধ্বনি ওঠে : ‘ভাই হত্যার বিচার চাই!’ এ যেন শোক নয়, রক্তের প্রতিজ্ঞা। রাষ্ট্র সহ্য করতে পারল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে, জাহাঙ্গীরনগরের অ্যাডমিন ভবনের সামনে আবার নেমে আসে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, রড আর ব্যাটন। সেদিন দুপুরে আসে আরেক নির্দেশ- সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খালি করে দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা তখন জানাজা শেষে ক্যাম্পাসে ফিরছিল, কেউ আহত বন্ধুকে খুঁজছিল, কেউ দুই দিন কিছু খায়নি। হঠাৎ মাইকে ঘোষণা- ‘হল ছাড়। ক্যাম্পাস বন্ধ। ’ শুধু ঢাকায় নয়- রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রংপুর- সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ আদেশ একযোগে কার্যকর হয়। এটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় কৌশল- শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্ন করে আন্দোলনের শেকড় কেটে ফেলার চেষ্টা। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। স্বজন হারানোর মেকি কান্না। অন্যায়, অপশাসন, নির্যাতন জায়েজ করার চিরাচরিত প্রহসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খালি করার পর সরকার ভেবেছিল- আন্দোলন থেমে যাবে। কিন্তু তারা ভুল করেছিল হিসাবের অঙ্কে। ১৮ জুলাই সকালেই ঢাকার রাজপথে নামে এক নতুন সুনামি- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ব্র্যাক, ইস্ট ওয়েস্ট, নর্থ সাউথ, আইইউবি, এআইইউবি, নর্দান, মাইলস্টোন-আরও জানা-অজানা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একযোগে রাস্তায় নামে। তারা গরম, ধুলোমাখা রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকে : ‘গণহত্যার বিচার চাই!’ গলায় ঝোলানো আইডি কার্ড, কাঁধে ব্যাগ, মাথায় পতাকাণ্ড কিন্তু বুকের ভিতর জ্বলছিল আগুন। অগ্রজদের সঙ্গে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই-বোনেরা রাস্তায় নেমে আসে। এদের অনেকেই আর ঘরে ফেরেনি। মুগ্ধ, পানি বিলাতে বিলাতে মাথায় গুলি খেয়ে শহীদ হয়। ১৭ বছরের কিশোর ফাইয়াজ শহীদ হয় ধানমন্ডিতে। উত্তরা, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। দুপুর থেকে হেলিকপ্টার থেকে কাঁদুনে গ্যাস আর গুলিবর্ষণ শুরু হয়। বাসার ভিতর, ছাদে, মায়ের কোলে শিশুরাও মারা যায়। ঢাকার প্রতিটি মোড়ে, বাসস্ট্যান্ডে, গলির মাথায় ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধ। সান্ধ্য আইন জারি করা হলো। এর কিছু পরেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীদের ওপর নেমে আসে আরেক দফা নির্যাতন। মাঠের ছেলেরা গুম হয়, কর্মীদের উঠে বসার আগেই পেটানো হয়। গ্রেপ্তার এড়াতে আমার আর বাসায় থাকা হয়ে উঠল না- থাকলাম পথে পথে, পরিবার ছেড়ে, এক বন্ধু থেকে আরেক বন্ধুর বাসায়, মোবাইল বন্ধ করে। আমার অপরাধ- আমি প্রশ্ন করেছি, আমি লিখেছি, আমি স্বপ্ন দেখিয়েছি।
আন্দোলন পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। ৪ আগস্ট সকাল থেকেই ঢাকার রাজপথে একটাই আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল- ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাই!’ হাজার হাজার মানুষ জড়ো হচ্ছিল শাহবাগ, টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, কার্জন হলে। শহীদ মিনার থেকে ঘোষণা এলো, ‘এই রক্তের পাহাড় পেরিয়ে আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ’ এই দিনেই প্রথম ঘোষণা আসে- ‘ঢাকামুখী লংমার্চ’। প্রথমে বলা হয় ৬ আগস্ট হবে, কিন্তু বিকালের পরপরই বিক্ষোভকারীদের চাপ, জনতার উত্তেজনা ও শহীদদের সংখ্যার ভারে সিদ্ধান্ত হয়- লংমার্চ হবে পরদিনই, ৫ আগস্ট। ঢাকায় বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল এক নীরব প্রতিজ্ঞায়- পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত পিছু হটা নয়।
৫ আগস্ট সকাল বেলা, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ, ঢাকা শহর যেন নিঃশ্বাস আটকে বসেছিল। সবাই জানত- কিছু একটা ঘটবে, একটা বিস্ফোরণ, কিংবা রক্তস্নান। গণভবন ঘিরে যুদ্ধের প্রস্তুতি, মেশিন গান বসানো। ঢাকায় ঢোকার প্রতিটা মুখে রণসজ্জা। কিন্তু মানুষ তো ভয় জয় করে ফেলেছে। তারা আসছিল চারদিক থেকে- পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ-লাখে, লাখে। তারা ছিল নিরস্ত্র, সংকল্পে অটল। তারা হেঁটে চলেছিল গণভবনের অভিমুখে- শান্ত, অবিচল। ‘শেখ হাসিনা পালায় না’। এ কথাটাই তো তিনি নিজে বলেছিলেন মাত্র কিছুদিন আগে- জনসম্মুখে, দম্ভভরে। কিন্তু ৫ আগস্ট দুপুরে সেই শেখ হাসিনাই পালিয়ে গেলেন। পালালেন পণ্য বহনের বিমানে করে, ভারতে। এক সংক্ষিপ্ত বার্তা চোখের পলকে চাউর হয়ে যায়- ‘শেখ হাসিনা পালাইছে’। মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ল- কেউ হাসল, কেউ কাঁদল, কেউ চিৎকার করল। মিষ্টির দোকান নিমেষে খালি। অন্তহীন দুঃস্বপ্ন যেন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল। যাত্রাবাড়ী, চাঁনখারপুল, সাভার- এসব জায়গায় কিছু ‘নির্বোধ বাহিনী’ শেষ মুহূর্তে গুলি ছুড়েছিল। নিহত হন অনেকেই- তাদের রক্তেও ভিজে থাকে সেই দিনের পতাকা। কিছুই থামাতে পারেনি জেগে ওঠা বিজয়ী জনতাকে। তারা ঢুকে পড়ে গণভবনে। আরেক দল ছুটে যায় সংসদ ভবনের দিকে। তারা বলে- এই সংসদ আর কেবল একটি দলের নয়, এখন এটি পুরো জাতির। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ছাদে দেখা যায় পতাকা উড়াচ্ছে হাজারো তরুণ। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও ঢাকার বিভাগীয় অফিস- সব কটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। ‘শেখ হাসিনা পালাইছে’- এই শব্দটি শুধু বিজয়ের উল্লাস নয়- এটা একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষার ভারমুক্তি। এই ইতিহাস কেউ মুছতে পারবে না। এখন সময়- এই ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার, শহীদদের নাম রক্ষার, প্রতিরোধের স্মারক গড়ে তোলার। আমি এই রাষ্ট্রের সেই শিক্ষক, যাকে বলা হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহী। আজ আমি বলছি- এই রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক ছিল সেই সব তরুণ-তরুণী, যারা চোখ তুলে বলেছিল : ‘তুমি কে, আমি কে? বিকল্প! বিকল্প!?’
♦ লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; আহ্বায়ক, সাদা দল