ঢাকা, রবিবার, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ জুলাই ২০২৫, ০১ সফর ১৪৪৭

মুক্তমত

তরুণদের পছন্দে কী বার্তা লুকানো

ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:০৯, জুলাই ২৭, ২০২৫
তরুণদের পছন্দে কী বার্তা লুকানো ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গঠনে তরুণদের মতামত ও মনোভাব কেমন, তা বোঝার এক তাৎপর্যপূর্ণ জানালা খুলে দিয়েছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জরিপ। জরিপ অনুযায়ী, বিএনপি পেয়েছে ৩৯ শতাংশ তরুণের সমর্থন, জামায়াতে ইসলামী ২১ শতাংশ এবং নবগঠিত এনসিপি পেয়েছে ১৬ শতাংশ।

এই সংখ্যা নিছক পরিসংখ্যান নয়, বরং একদিকে রাজনৈতিক বার্তা, অন্যদিকে সমাজের মনস্তাত্ত্বিক অভিব্যক্তি। এটি আমাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি তরুণদের আস্থার সংকট এবং বিকল্পের সন্ধানের দিকেও স্পষ্ট ইঙ্গিত করে।

আরো উদ্বেগজনক হলো, প্রায় ৮৩ শতাংশ তরুণ ভবিষ্যতে রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণে আগ্রহী নয়। এটি শুধু রাজনীতিবিমুখতার চিত্র নয়, বরং একটি প্রজন্মের হতাশা, নিরুৎসাহ এবং আত্মবিশ্বাসহীনতার প্রতিফলন, যা গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য অশনিসংকেত।

জরিপটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য? প্রথমেই আসে জরিপের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন। জরিপটি কতটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে, কতজনের ওপর, কত অঞ্চলে এবং কিভাবে পরিচালিত হয়েছে—এসব প্রশ্নের স্বচ্ছ উত্তর প্রয়োজন।

তথ্য সংগ্রহে পক্ষপাত থাকলে ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। তথাপি পদ্ধতিগত ঘাটতি থাকলেও এটি তরুণসমাজের মধ্যে বিরাজমান রাজনৈতিক অনুভূতির একটি রূপরেখা হিসেবে ধরা যায়।
তরুণদের আস্থা কোথায় হারাল? এই জরিপের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা হলো, তরুণরা রাষ্ট্রের মূলধারার শাসনব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়েছে। সরকারি দলের প্রতি প্রায় অনুপস্থিত সমর্থন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি হতাশা ও দূরত্বের ইঙ্গিত দেয়।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব তরুণদের কাছে রাজনীতিবিমুখ করে তুলেছে। তার পরও রাজনীতির প্রতি তরুণদের আস্থা হারানোর পেছনে কারণ কী, তা অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।

জামায়াতের প্রতি সমর্থন—প্রতিবাদ, নাকি আত্মসমর্পণ? জামায়াতে ইসলামীর প্রতি তরুণদের সমর্থন কিছুটা বেড়েছে বলেই মনে হয়। এটি কি কেবল ধর্মীয় অনুরাগ, নাকি রাজনৈতিক ভিন্নমাত্রার আকাঙ্ক্ষা? জামায়াত নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সমর্থন আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোর সীমাবদ্ধতা ও তরুণদের মধ্যে বিকল্প ভাবনার সন্ধানকেই ইঙ্গিত করে। জামায়াতের প্রতি এই সমর্থন কি বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি প্রতিবাদ?

এনসিপি : নতুন রাজনীতির বার্তা কী? নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির প্রতি ১৬ শতাংশ তরুণের সমর্থন একটি নতুন ধারার রাজনীতির ইঙ্গিত দেয়।

তরুণরা আধুনিক, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ নেতৃত্ব প্রত্যাশা করে। এই সমর্থন কেবল ‘বিকল্পের খোঁজ’ নয়, বরং গণমুখী রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ। তবে এনসিপির উত্থান টেকসই নেতৃত্বের সূচনা হবে, নাকি শুধুই একটি ক্ষণস্থায়ী প্রতিবাদ, তা সময়ই বলে দেবে।
বিএনপি : বিএনপি তরুণদের সর্বোচ্চ সমর্থন পেয়েছে। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই দেশের একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। অতীতে অনেকবার ক্ষমতায়ও গেছে। তার পরও প্রশ্ন থেকেই যায়, দলটি তরুণসমাজকে কতটা আকৃষ্ট করতে পারছে? দলটি কতটা সংগঠিত?

এই জরিপে তরুণদের যে পছন্দ উঠে এসেছে, তা কোনো চূড়ান্ত চিত্র নয়। তার পরও এটি রাজনীতির সামনে একটি আয়না, যেখানে নেতৃত্ব দেখতে পায় তরুণদের প্রত্যাশা, বিতৃষ্ণা এবং সংকেত। এটি পরিতাপের বিষয় যে তরুণরা ক্রমেই রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বা যেতে চাচ্ছে। রাজনৈতিক সংস্কার, তরুণবান্ধব নীতি, গবেষণা ও সংলাপ এবং সর্বোপরি নিরপেক্ষ, প্রতিযোগিতামূলক ও আধুনিক নির্বাচনী ব্যবস্থাই তরুণদের রাজনৈতিক আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।

এই জরিপ কেবল একটি পরিসংখ্যানগত নথি নয়, এটি এক ধরনের রাজনৈতিক থার্মোমিটার। তরুণদের মন বুঝতে না পারলে রাজনীতি শুধু দুর্বল হবে না, বরং অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।  

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

akmhumayun@cvasu.ac.bd

সৌজন্য: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।