ঢাকা, রবিবার, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ জুলাই ২০২৫, ০১ সফর ১৪৪৭

মুক্তমত

এ দুর্যোগ ও দুর্বিপাকের শেষ কোথায়

গাজীউল হাসান খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:১৪, জুলাই ২৭, ২০২৫
এ দুর্যোগ ও দুর্বিপাকের শেষ কোথায়

আর কত বুকভাঙা ঘটনা ঘটলে এ দেশের হতভাগা মানুষের দুঃখ-বেদনার অবসান ঘটবে? আর কত ভাগ্যবিড়ম্বনা হলে এ দেশের মানুষের দুঃসময় দূর হবে? এ প্রশ্ন যেন আজ শোকাহত প্রত্যেক সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। কাদের অপরাধে সর্বত্র আজ এই ধারাবাহিক বিপর্যয়ের ঘনঘটা।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানবসৃষ্ট নৈরাজ্য, সব যেন পালা করে চেপে বসছে এ জাতির জীবনে। সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর, তারপর আরো ৫৩ বছর কেটে গেল, এ জাতির ভাগ্য বদল হলো না।

অপশাসন ও শোষণমুক্ত একটি শান্তি-স্বস্তির স্বদেশ তো এখনো পেলাম না আমরা। অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন তো হাতের নাগালে পাওয়া দূরের কথা, রাজনীতির নামে অনেকেই আবির্ভূত হলেন নিকৃষ্ট শাসক, শোষক, প্রবঞ্চক, ধিক্কৃত নরহত্যাকারীর ভূমিকায়।

বিগত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ফ্যাসিবাদবিরোধী অভ্যুত্থানে প্রাণ হারিয়েছে দেড় সহস্রাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। এতে তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটলেও অবসান ঘটেনি তাদের অনুসারীদের তাণ্ডবের।

গোপালগঞ্জে সংঘটিত আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উপর্যুপরি হামলা আবার দেশের গণতান্ত্রিক আবহকে বিনষ্ট করে স্বেচ্ছাচারের ধারাবাহিকতাকেই যেন উসকে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা কিংবা চক্রান্তের মধ্য দিয়ে মানবসৃষ্ট ধারাবাহিক দুর্যোগের মধ্যে যোগ হয়েছে আরেক অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ। আর সেটি হচ্ছে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ স্থাপনায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা। হৃদয়বিদারক সে দুর্ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত জ্বলে-পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছে ৩৪ জন ছাত্র ও শিক্ষক।

হাসপাতালের শয্যায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরো অনেকে। এই অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ ও ধারাবাহিক বিপর্যয়ে এখন প্রায় হতবিহ্বল দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ। এ অবস্থায় তাদের শুধু একটি জিজ্ঞাস্য—এ দুর্যোগ ও দুর্বিপাকের শেষ কোথায়?

দীর্ঘদিনের এ ধারাবাহিক বিপর্যয়ের পরও এ দেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধে রয়েছে কোনো এক সুসময়ের অপেক্ষায়, যা তাদের অন্তত মানবসৃষ্ট দুর্ভোগের হাত থেকে রক্ষা করবে। সীমাহীন সমস্যা ও সম্ভাবনার দেশ—বাংলাদেশ। এ দেশের বহুমুখী সম্ভাবনা চাপা পড়ে রয়েছে মানবসৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার কারণে।

৫৩ বছরে আমরা আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের অনেক সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অদক্ষতা, ব্যর্থতা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং দূরদর্শিতার অভাবে বেশির ভাগ সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। তদুপরি আমাদের রাজনৈতিক মহলে রয়েছে দুর্নীতি, স্বার্থপরতা এবং কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার নির্লজ্জ প্রয়াস, যার প্রমাণ আমরা বারবার পেয়েছি।

স্বৈরাচার, দুর্নীতি ও অপশাসন অবসানের লক্ষ্যে বহু সার্থক বা সফল গণ-আন্দোলন এবং অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। এতে বহু প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে, কিন্তু বারবার কোনো না কোনো কায়েমি স্বার্থ কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থপরতার কাছে আমরা শেষ পর্যন্ত হেরে গেছি। আবার নতুন করে শুরু করতে হয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলন। আমাদের সংবিধান, সংসদ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, এমনকি সাম্প্রতিক সংসদ নির্বাচনগুলোও জাতীয় প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। তথাকথিত উন্নয়নের স্লোগানের আড়ালে গণতন্ত্রের কবর রচনা করে এক দানবীয় ফ্যাসিবাদের জন্ম দেওয়া হয়েছিল। বিগত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে,  সেটি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তনের এক অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দাবি করেছে রাষ্ট্রের যথাযথ মেরামতের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের ব্যাপারে। বর্তমান অন্তর্বর্তী প্রশাসন একটি অরাজনৈতিক সরকার হতে পারে, কিন্তু এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এই সরকারের প্রধান প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রশ্নে একজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি। প্রয়োজনীয় কিংবা জরুরি সংস্কার এবং সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারপ্রধান তাঁর বিভিন্ন ভাষণে পরিষ্কার করে অনেক কিছুই বলেছেন, প্রতিদিন নতুন করে যার আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। এ অবস্থায়ও দেশের বিভিন্ন দায়িত্বশীল দল বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারে না। অথচ তাদের অনেকে এখনই দেশে নির্বাচন চায়। এ ধরনের নির্বাচন তারা অতীতে বহুবার করেছে, কিন্তু তাতে দেশ ও জাতি তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে দেশব্যাপী অনেক দলের শক্তি প্রদর্শন কিংবা শোডাউন শুরু হয়ে গেছে। এতে রাজধানী ঢাকা মাঝেমধ্যে অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে একটি বিষয় রাজনীতিসচেতন মানুষের দৃষ্টি এড়াচ্ছে না আর তা হলো, নির্বাচন সামনে রেখে বড় বড় দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোনো সাংগঠনিক সংস্কার নেই। এ অবস্থায় দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের নিয়ে কত দিন দেশ চালাতে পারবে তারা? যারা দেশের সবকিছু সংস্কারের বেলায় সোচ্চার, তারা নিজ নিজ দলের সংস্কার কিংবা প্রয়োজনীয় শুদ্ধি অভিযানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব। বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি কথা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেছে যে দেশের ভবিষ্যৎ কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের জন্য এখন চাই তরুণ, সৎ ও শিক্ষিত নেতৃত্ব। অতীতের চাঁদাবাজ, ধান্দাবাজ, সন্ত্রাসী ও মাস্তানদের দিয়ে এখন আর দলকে ধরে রাখা যাবে না।

বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য এখন চাই শিক্ষিত, সৎ ও তরুণ মেধাবী নেতৃত্ব। নতুবা ঘাটে ঘাটে ধরা খেয়ে যাবে ভবিষ্যৎ সরকারগুলো। আন্দোলনের তোড়ে ভেসে যাবে বানের পানির মতো। বাবার পরিচয়ে বখে যাওয়া ছেলে কিংবা আত্মীয়-স্বজন দুর্নীতির পাহাড় গড়তে অথবা ক্ষমতার বলয় তৈরি করতে সক্ষম হবে না। সে কারণেই এখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষিত, প্রযুক্তিসমৃদ্ধ এবং বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ সমর্থক ও জনবল তৈরি করতে হবে। এবং সে অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে নতুবা সংসদ, সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্যান্য মন্ত্রীর বাসভবন রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন থেকে সেভাবে তাদের দলীয় নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করতে হবে। তা ছাড়া বর্তমানে চলমান প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নতুবা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বাধার মুখে পদে পদে আটকে যাবে ক্ষমতাসীন দল। জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন এক নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে দিকে দিকে। সে অবস্থায় কথায় কথায় রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়লে দেশ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্থবির বা অবরুদ্ধ হয়ে পড়তে পারে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উপপ্রধান ড. আলী রীয়াজ সংস্কারের প্রশ্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গত সপ্তাহে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের সঙ্গে বসেছিলেন। পরে আরো ১৩টি দলের নেতাদের সঙ্গে কমিশন বৈঠক করে। আলোচনা শেষে জানা যায়, কমিশন বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন জরুরি সংস্কার ও সামনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সে ঐকমত্যে পৌঁছার বিষয়টি একটি অত্যন্ত অর্থবহ অগ্রগতি বলে কমিশন জানায়। এতে আশা করা যাচ্ছে যে প্রস্তাবিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি সবকিছু ঠিকমতো এগোলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে সম্পন্ন করা সম্ভব হতেও পারে।

উল্লেখ্য যে অতীতে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কাজে হাত দেয়নি। সে ক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কিছু মতবিরোধ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এর পাশাপাশি সম্প্রতি গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের পতিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের আক্রমণের মুখে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সুরক্ষিত যানে করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে কেউ কেউ তাঁদের প্রতি সরকারি আনুকূল্য হিসেবে সমালোচনা করেছেন। তা ছাড়া ছাত্রদের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে দেওয়ার পেছনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মদদ বা পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগেও একটি মহল কঠোর সমালোচনা করেছে। সেটিকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে যথেষ্ট পাল্টা সমালোচনাও গণমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অংশটির মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের আন্দোলনের ফলেই মূলত আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি, একাত্তরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করতে পেরেছি। তা ছাড়া স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ছাত্রদের নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন গণ-অভ্যুত্থান, যাতে স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে। কোনো প্রথাগত রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব হয়নি দেড় দশক ধরে তথাকথিত আন্দোলন করে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার পতন ঘটানো। সেটি মূলত সম্ভব হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে। অতীতে কোনো সফল ছাত্র আন্দোলনের ফসল জনগণ ঘরে তুলতে সক্ষম হয়নি। এর ফলাফল ভোগ করেছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। সে বিবেচনায় দেশের উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা যদি কোনো দল গঠন করে, তাতে আইনগতভাবে আপত্তির কী আছে? আর যা-ই হোক, দেশবাসীর অনেকেই এখন চায় যে শিক্ষিত যুবকরা রাজনীতিতে আসুক, অশিক্ষিত, মাস্তান, চাঁদাবাজ ও ধান্দাবাজরা নয়।  

লেখক: বাংলাদেশ সংসাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।