বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো পুরোপুরি ঐক্য দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর যথেষ্ট টানাপড়েন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
সংগত কারণেই নির্বাচন প্রসঙ্গটি সবার কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠছে। অথচ নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য থেকেই গেছে। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো যথাযথভাবে জনগণের কাছে পৌঁছতে পারছে কি না কিংবা পৌঁছানোর চেষ্টা করছে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রধান কাজ।
বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য মাঝেমধ্যে এই ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটে। টানাপড়েন যতই বাড়বে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ততই সামনে আসবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ হলো দেশে একটি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা এবং এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে সেই পরিবেশ তৈরি করা।
কিন্তু নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বেড়েই চলেছে। কবে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন—এই প্রশ্নের এখনো স্পষ্ট কোনো উত্তর কেউই দিতে পারছে না।
নির্বাচন কখন হবে, কিভাবে হবে—এ বিষয়ে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতামত এবং অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাজনীতিতে তারা এখন বিশেষ ফ্যাক্টরে পরিণত হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণদের এই দলটি আলাদা ধরনের গুরুত্ব বহন করছে বলে পরিষ্কার ধারণা করা যায়।
সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন এখন এই দলটির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। তারা কখন কিভাবে নির্বাচন চাইবে, কোন সময় চাইবে, কোন শর্তে চাইবে, সংস্কার এবং বিচারের আগে, না পরে—এ ধরনের অনেক বিষয়ের সঙ্গেও সরকারের সদিচ্ছার প্রসঙ্গটি জড়িত বলে অনেকেই মনে করেন।
এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ১১ মাস অতিবাহিত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনের যেমন সুস্পষ্ট রোডম্যাপ সরকারের পক্ষ থেকে আসেনি, ঠিক তেমনি কোনো রাজনৈতিক দলও তাদের জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক রোডম্যাপ যথাযথভাবে ঘোষণা করেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো ভিশন আমাদের সামনে সুনির্দিষ্টভাবে উত্থাপিত হয়নি। এমনকি এনসিপি যে জুলাই পদযাত্রা করছে, সেটি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হলেও কম সময়ে সারা দেশের মানুষের সঙ্গে যথাযথ মিথস্ক্রিয়া করতে পারছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এরই মধ্যে জামায়াত একটি জাতীয় সমাবেশ করে আগামী দিনে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে। অন্যদিকে বিএনপিও নিজেদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে অপেক্ষাকৃত দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কারণ আমরা জানি, যেকোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণ সাধন করা। এ ক্ষেত্রে জনগণ যেভাবে চায়, ঠিক সেভাবেই তাদের কাজ করতে হয়।
নির্বাচনের দিন-তারিখ ঠিক হলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা-ও কিন্তু নয়। রাজনীতিতে টানাপড়েন বাড়তে থাকলে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়তে থাকবে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে সব পক্ষকে একটি যথাযথ এবং ন্যায্য দিকে হাঁটতে হবে। কারণ যথাযথ রাস্তায় হাঁটতে না পারলে কোনোভাবেই দেশে ইতিবাচক রাজনীতির সূত্রপাত হবে না। এ কারণে প্রয়োজন একটি উইন-উইন পরিস্থিতির। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক পক্ষকেই বিশেষ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকতে হবে। সব পক্ষ থেকে ছাড় দিতে না পারলে কোনোভাবেই উইন-উইন পরিস্থিতি আশা করা যায় না।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি শতাধিক নিবন্ধনহীন এবং ব্যক্তিনির্ভর দল রয়েছে। যেসব নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দিয়েছে, সেগুলোর অনেকগুলোরই কোনো অফিস নেই, আবার অফিস থাকলেও সভাপতির নিজের বাসার ড্রয়িংরুম অফিসের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি। এমনকি বেশির ভাগই প্রাথমিক যোগ্যতা পূরণ করতে পারেনি বলে নির্বাচন কমিশন চিঠি দিয়ে জানিয়েছে।
অনেক দল রয়েছে, যেগুলোর সভাপতির নাম পাওয়া যায়, কিন্তু সাধারণ সম্পাদকের নাম পাওয়া যায় না। এ ছাড়া বিদ্যমান নিবন্ধিত অনেক দলই সাইনবোর্ডসর্বস্ব রাজনৈতিক দল। নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে কয়েকটি ছাড়া আর কারো তেমন জনসমর্থন নেই। বাকি দলগুলোর তেমন একটা জনসমর্থন না থাকলেও দলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিশাল বিশাল সাইনবোর্ড রয়েছে। এদের তৎপরতা দেখা যায় শুধু নির্বাচন মৌসুম এলেই। নির্বাচনের আগে এই দলগুলোর কদর বেড়ে যায়। বড় দলগুলোর সঙ্গে জোটভুক্ত হওয়া, নির্বাচনে মনোনয়ন এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির দর-কষাকষি চলে।
যেকোনো রাজনৈতিক দল বৈধ এবং সাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক দলগুলো জোট গঠন করেও ক্ষমতায় আসে এবং আসার চেষ্টা করে। আমাদের দেশে বিদ্যমান নামসর্বস্ব দলগুলোর কোনো জনসমর্থন নেই।
আমরা আশা করব, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিকার অর্থেই জনগণের জন্য কাজ করবে। এমনকি সব দল এবং দলের নেতারা সহনশীল হবেন, সংযত হবেন। অতীত বা বিগত দিনগুলোর অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে দেশবাসীর কল্যাণের রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবেন, যাতে দেশ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারায় চলতে পারে, যাতে দেশে কোনো অপশক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার মতো অবস্থা ভবিষ্যতে সৃষ্টি না হয়। রাজনীতিতে প্রতিহিংসা এবং পারস্পরিক টানাপড়েন যত কমিয়ে আনা যাবে, ততই দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে। এ ক্ষেত্রে সব পক্ষকে একটি যথাযথ এবং ন্যায্য দিকে হাঁটতে হবে। কারণ যথাযথ রাস্তায় হাঁটতে না পারলে কোনোভাবেই দেশে ইতিবাচক রাজনীতির সূত্রপাত হবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোক মনে রাখতে হবে, ভোটের রাজনীতিতে বিজয়ী হওয়ার একমাত্র হাতিয়ার হলো সাংগঠনিক ভিত্তি এবং জনসমর্থন। দলের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত না হলে এবং জনসমর্থন না থাকলে সেই দল নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে না। প্রসঙ্গত বলতে হয় যে নতুন দলগুলোর উচিত সাধারণ মানুষের জন্য ব্যতিক্রম চিন্তা বা জনমুখী কর্মসূচি নিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বাস্তবতাবিবর্জিত রাজনৈতিক দর্শনের কারণেও অনেক দল মানুষের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে না। ফলে জনসমর্থনও বাড়ে না, বরং হিংসা-বিদ্বেষ এবং হানাহানির পরিবেশ তৈরি হয়। আর মোটাদাগে ওই সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের ফলাফল নেতিবাচক হয়।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ