ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৩ সফর ১৪৪৭

মুক্তমত

বাণিজ্যচুক্তি: ভিয়েতনাম পারলে আমরা নয় কেন

নিরঞ্জন রায় | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:০০, জুলাই ২৯, ২০২৫
বাণিজ্যচুক্তি: ভিয়েতনাম পারলে আমরা নয় কেন নিরঞ্জন রায়

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই সমগ্র বিশ্বে এক অর্থনৈতিক ঝড় তুলে ফেলেছেন, যার কবলে পড়ে অনেক দেশের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন। এই ক্ষতির শঙ্কা থেকে বাদ যাচ্ছে না বাংলাদেশও।

যেসব দেশের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে, তাদের বিরুদ্ধে ট্রাম্প নির্বিচারে উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করেছেন। এই শুল্ক আরোপের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে অনেক দেশ আমেরিকার বিরুদ্ধেও কিছু বাণিজ্যিক পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।

ফলে বিশ্বে দেখা দিয়েছে এক ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ, যার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে উচ্চহারের শুল্ক।

ট্রাম্পের এ রকম বাণিজ্যযুদ্ধ অপ্রত্যাশিত ছিল না মোটেই। অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে এ রকম কিছু একটা করবেন। বিশেষ করে চীনসহ কয়েকটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে ট্রাম্প উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করবেন, তা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল।

কিন্তু এভাবে নির্বিচারে দীর্ঘদিনের বন্ধু ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র এবং নিকট প্রতিবেশী ও খুবই ঘনিষ্ঠ কানাডার মতো দেশের বিরুদ্ধেও যে ট্রাম্প প্রশাসন উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করবে, তা অনেকের কল্পনার মধ্যেও ছিল না। এমনকি ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের লক্ষ্য থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশও, যারা কিনা আমেরিকার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অন্যতম সরবরাহ উৎস হিসেবে কাজ করে।

বাণিজ্যচুক্তি : ভিয়েতনাম পারলে আমরা নয় কেনট্রাম্পের এ রকম নির্বিচারে শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্বব্যাপী যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার প্রভাবে ধনী-গরিব-নির্বিশেষে সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে। তবে ধনী দেশগুলোর ক্ষতির ধরন এবং পরিমাণ ভিন্ন।

শুধু তা-ই নয়, ধনী দেশগুলোরও আমেরিকার বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের সক্ষমতা আছে। ফলে সেসব দেশ তাদের ক্ষতির মাত্রা কমাতে এবং অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়েও নিতে পারে। পক্ষান্তরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সে সুযোগ নেই। কারণ আমেরিকার বিরুদ্ধে উন্নয়নশীল দেশের পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। উল্টো আমেরিকার দাবিদাওয়া বিনা বাক্যে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।

তদুপরি উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের পরিমাণ খুবই সামান্য, বলা যেতে পারে হাতে গোনা কয়েকটি। আমাদের দেশের অবস্থা তো বেশি শোচনীয়। কেননা তৈরি পোশাক হচ্ছে আমাদের দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। শুধু তা-ই নয়, এই রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে আমেরিকা। তাই যেকোনো কারণে আমেরিকার বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হলে সমগ্র রপ্তানি খাতই হুমকির মধ্যে পড়ে যায় এবং বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পথ সংকটে থাকে।

এ কথা ঠিক যে ট্রাম্প একতরফাভাবেই এই বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন। ফলে এই উচ্চহারের শুল্কের প্রভাব যে শুধু আরোপিত দেশের ওপর পড়েছে তেমন নয়, এর প্রভাব আমেরিকার অর্থনীতি এবং ভোক্তাদের ওপরও যথেষ্টই পড়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে আমেরিকার অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসা অস্বাভাবিক ছিল না। এ কারণেই ট্রাম্প উচ্চহারের শুল্ক আরোপের কার্যকারিতা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন, যাকে অনেকেই বাণিজ্যযুদ্ধবিরতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই ৯০ দিনের বাণিজ্যযুদ্ধবিরতির মেয়াদ গত ৯ জুলাই অতিবাহিত হয়ে গেলে এর মেয়াদ আগস্টের ১ তারিখ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। এরপর এই যুদ্ধবিরতির মেয়াদ আবারও বৃদ্ধি পাবে, নাকি অতি শুল্কহার কার্যকর হবে, তা দেখার জন্য আমাদের আরো কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।

ট্রাম্প প্রশাসনের একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পেছনে একটি উদ্দেশ্য ছিল। তাদের ধারণা ছিল যে এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দেশ আলোচনার মাধ্যমে আমেরিকার সঙ্গে একটি গ্রহণযোগ্য বাণিজ্যচুক্তিতে পৌঁছতে পারবে। এর ফলে উচ্চহারের শুল্কের একটি সন্তোষজনক সমাধান হবে এবং বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট বাণিজ্য উত্তেজনা প্রশমিত হবে। কিন্তু যুক্তরাজ্য, চীন ও ভিয়েতনাম ছাড়া আর কোনো দেশই আমেরিকার সঙ্গে উচ্চ শুল্কহারের বিষয়টি সুরাহা করতে পারেনি। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের ব্যাপারটি একেবারেই ভিন্ন। কেননা আমেরিকার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের আছে একান্ত বোঝাপড়া। ফলে ব্রিটেন খুব সহজেই ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শুল্ক সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান করতে পেরেছে। চীন অবশ্য আলোচনার মাধ্যমে নয়, পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আরোপিত শুল্কহার হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে।

আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি বলতে যা বোঝায়, তা ভিয়েতনামই প্রথম করতে সক্ষম হয়েছে। এই চুক্তির কারণে আমেরিকা ভিয়েতনাম থেকে পণ্য আমদানির ওপর শুল্কহার আগে আরোপিত ৪৬ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এমনকি ভিয়েতনাম হয়ে অন্যান্য দেশের যে পণ্য রপ্তানি হবে, তার ওপরও শুল্কহার হ্রাস করে ৪০ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করেছে, যা আগে অনেক বেশি ছিল। ভিয়েতনাম হচ্ছে আমেরিকার অষ্টম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার, যাদের সঙ্গে গত বছর ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ভিয়েতনামের সঙ্গে আমেরিকার আছে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি, যার পরিমাণ প্রায় ১২৩ বিলিয়ন ডলার।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে শুধু যে ভিয়েতনাম আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদন করে উচ্চ শুল্কহারের সন্তোষজনক সমাধান করেছে তেমন নয়। ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন যে ফিলিপিন্সের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্যচুক্তি সম্পন্ন হয়েছে এবং এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার উচ্চ শুল্কহারের বিষয়টির একটি সন্তোষজনক সমাধান হবে। ইন্দোনেশিয়াও আমেরিকার সঙ্গে একটি বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদনের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। শিগগিরই হয়তো এ রকম একটি চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পাদিত হবে এবং উচ্চ শুল্কহারের সন্তোষজনক সমাধান হবে।

ভিয়েতনামের সঙ্গে আমেরিকার সফল বাণিজ্যচুক্তি এবং এর পাশাপাশি যদি ফিলিপিন্স ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদন হয়েই যায়, তাহলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি মারাত্মক সংকটে পড়তে পারে। কেননা এই দেশগুলো বাংলাদেশের প্রতিযোগী এবং আমেরিকার ব্যবসায়ীরা তখন বাংলাদেশের পরিবর্তে ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভিয়েতনাম আমেরিকার সঙ্গে শুল্ক সমস্যার সমাধান করে বাণিজ্যচুক্তি করতে পারলে আমরা কেন পারছি না?

ভিয়েতনামের সঙ্গে আমেরিকার বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি আছে এবং ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে চীনের রপ্তানিকারকরা ভিয়েতনামের মাধ্যমে আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি করে থাকেন। সেই ভিয়েতনামই সবার আগে আমেরিকার সঙ্গে সফল বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদন করে ফেলল। অথচ আমরা এখন পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে আলোচনা এবং পত্র চালাচালির মধ্যেই আটকে আছি। ফলে আমাদের দেশের বৃহত্তম রপ্তানি খাতটি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে বসেছে। কারণ ভিয়েতনাম যেভাবে বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদন করেছে, আমরা সেভাবে অগ্রসর হতে পারিনি। শুধু সরকারি পর্যায়ে আলোচনা এবং গতানুগতিক চিঠি চালাচালির মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এ জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—(১) দেশের ব্যবসায়ীদের, বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিদের নিয়োজিত করা; (২) আমেরিকার যেসব বৃহৎ কম্পানি এবং ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান পোশাক আমদানি করে, তাদের সহযোগিতা নেওয়া; (৩) প্রয়োজনে এই কাজে সহযোগিতা করার জন্য লবিইস্ট ফার্ম নিয়োগ দেওয়া; (৪) বাংলাদেশের বাজারে আমেরিকার কিছু পণ্যের শুল্কমুক্ত বা অল্প শুল্কে আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করা এবং (৫) দেশে দ্রুত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এ রকম কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলে ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স ও ইন্দোনেশিয়ার মতো আমরাও আমেরিকার সঙ্গে একটি বাণিজ্যচুক্তিতে উপনীত হতে পারি, যার মাধ্যমে আরোপিত শুল্কহার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ হচ্ছে একটি কৌশলী পদক্ষেপ, যা কৌশলী আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে।

লেখক: সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।