ঢাকা, শুক্রবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২, ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

রক্তক্ষরণে ব্যবসায়ীরা, বিনিয়োগে ধ্বংসযাত্রা, চাকরিক্ষুধায় তারুণ্য

মোস্তফা কামাল, সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ |
আপডেট: ০৮:৩৭, অক্টোবর ১০, ২০২৫
রক্তক্ষরণে ব্যবসায়ীরা, বিনিয়োগে ধ্বংসযাত্রা, চাকরিক্ষুধায় তারুণ্য মোস্তফা কামাল

একটি গ্রামীণ প্রবাদ এমন—‘মরারে মারোস কেন? নড়েচড়ে যে। ’ অর্থাৎ মার খেতে হবে, উহ আহ করা যাবে না।

নড়াচড়াও মানা। নইলে মারের ওপর মার।

এমনিতেই পেশাদার, কমিটেড ছোট-বড় সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা মারের ওপর। যতদূর পারছে দম ধরে পড়ে থাকছে। তার ওপর নিপীড়ন। দোষী সাব্যস্ত করা।

সেবা রপ্তানিতেও করারোপ। দ্বৈত কর, কর ফাঁকিবাজ হিসেবে শনাক্ত, বৈশ্বিক বাজারের মূল্য আমলে না নেওয়া তো আছেই।

চরম নিষ্ঠুরতায় ধরেই নেওয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীরা মন্দজন। বিচার বা রায়ের আগেই শাস্তির মতো ব্যবসায়ীদের ফাঁকিবাজ ভেবেই কাজ শুরু করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।

কাউকে দোষী বা অপরাধী সাব্যস্ত করেই কাজ শুরু করা কতটা সম্মানের? আর বৈষম্য তো দিবালোকে। ই-কমার্স খাতে পণ্য বিক্রির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য। কিন্তু একই পণ্য অফলাইনে বিক্রি করলে ভ্যাট একদম অর্ধেক, সাড়ে ৭ শতাংশ। বিশ্বের কোনো দেশেই বেভারেজ পণ্যের করহার ৫০ শতাংশ নেই। বাংলাদেশে বেভারেজ পণ্যের কর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।

অবস্থার এমন বেগতিক দশায় কর্মদাতারাই দিনে দিনে কর্মহীন।

কখনো করারোপে, কখনো খেলাপি ঋণের দোহাই দিয়ে তাদের সামাজিকভাবে হেয় করার আর অবশিষ্ট থাকছে না। জানার পরও আমলে নেওয়া হচ্ছে না যে ঋণখেলাপি দুই রকমের। একটা মহল রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কিংবা অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা বের করে পাচার করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ পর্যাপ্ত নেই। অথবা ওভার ভ্যালুয়েশন করা আছে। যেগুলো নিলামে বিক্রি করলেও ঋণের টাকা উসুল হবে না। এরা প্রকৃতপক্ষে ব্যাংক ডাকাত। প্রতিটি ব্যাংক এসবের তথ্য জানে। নিজেদের পিঠ বাঁচাতে বিষয়গুলো গোপন রাখে। কারণ এসব খারাপ ঋণে ছিল ব্যাংক পরিচালক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশ। কিন্তু জাত ব্যবসায়ী, বনেদি বিনিয়োগকারী, শত শত, হাজার হাজার কর্মসংস্থান দেওয়া ব্যবসায়ীদেরও এক পাল্লায় মেপে তাদের এক অর্থে জিন্দা মেরে ফেলা হচ্ছে।

করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও তারা হাল ছাড়েননি। ব্যবসায় লোকসান করেও কর্মসংস্থান ধরে রেখেছেন। তারা যে কত ক্ষতিগ্রস্ত আজ পর্যন্ত সেটার কোনো পরিসংখ্যান করা হয়নি। ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যাংক এখন ১৬ শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশ সুদ চার্জ করছে। উপরন্তু আইএমএফের চাপে সরকার ঋণখেলাপির সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে। এখন এক কোয়ার্টার বা তিন মাস টাকা দিতে না পারলেই খেলাপি বলা হচ্ছে। একসময় এটার মেয়াদ ছিল এক বছর। গত সরকারের আমলে এটি ছয় মাসে নামিয়ে আনা হয়। এ সরকার এনেছে তিন মাসে।

হিসাবের এমন কায়কারবারের কারণে ঋণখেলাপির সংখ্যাও বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর ঋণদান সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ব্যবসা সংকুচিত হচ্ছে প্রতিদিন। আবার ব্যাংকের স্টাফদের পদবি অনুযায়ী সরলসুদ এবং ৫ শতাংশ সুদে হাউস বিল্ডিং, গাড়ি ক্রয়, কনজিউমার ঋণ দেওয়া হয়েছে। যেগুলোতে ব্যাংকের ঋণ প্রদান সক্ষমতা দেখানো হলেও আয় কম। অপরদিকে ব্যবসায়ীদের উচ্চহারে এবং চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর এ দ্বিচারিতা ব্যবসায়ীদের জান কবজ করার মতো। আর বাঁচলে মন্দলোক। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের হাতে ক্ষমতা রেখে এ বছর প্রথমার্ধে ঋণখেলাপিদের জন্য নতুন নীতিমালা জারি করে একটি কমিটি গঠন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ক্ষমতা দিয়ে নতুন আবার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। যেখানে ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে দুই বছর গ্রেস পিরিয়ড দিয়ে দশ বছর পর্যন্ত মেয়াদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃ তফসিলের অবস্থা কি আছে? ব্যবসার নামে দলবাজি-ঠকবাজি, দেশের অর্থ বিদেশে পাচারকারীদের বিষয় ভিন্ন। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের এ হিসাবে নেওয়া মানে তাদের রক্তক্ষরণের তীব্রতা আরো বাড়ানো।  

কেন্দ্রে ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলো এখনো অধীনস্ততায় ভুগছে। ঢাকার বাইরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রশাসক নিযুক্ত করে চলছে এপেক্স বডি। যার সঙ্গে জেলা চেম্বার কিংবা বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনগুলোর তেমন যোগাযোগ নেই। কথায় আছে ‘সেরের ওপর সোয়াসের’-এর মতো সেখানে আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতিমালার সার্কুলার। উচ্চ সুদের হার, ডলারের উচ্চমূল্য, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি এবং পণ্যের চাহিদার লাগামে টান পড়া বিবেচনার বালাই নেই। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার চেষ্টার বিপরীতে আপডেট হিসাবে মূল্যস্ফীতি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এখন রেকর্ড উচ্চতায়। এমন নিপাতনের মাঝেই নিরাপত্তা ও আস্থাহীনতায় কোনো মতে দম নিয়ে টিকে থাকা নিয়োগদাতাদের। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে তা ছেদ ফেলাই অবধারিত। একের পর এক মিল-কারখানার চাকা বন্ধের জেরে লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মহীন হয়ে পড়া। বেকারত্ব ও দারিদ্র্য জেঁকে বসাতে আর কী লাগে! বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণেও তা পরিষ্কার। সেখানে দগদগে ঘায়ের মতো উঠে এসেছে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে চরম ধাক্কার কথা।

ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা এ পরিস্থিতির মাঝে নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা, চলমানে বা বিদ্যমানে যা আছে সেটা রক্ষায়ও কুলাতে পারছেন না। লোকসানের ঘানি টেনে কোনো মতে ব্যবসা ধরে রাখাই এখন তাদের কাছে অনেক কিছু। কোমায় চলে যাওয়ার অবস্থা কারো কারো। বাকিরা স্যালাইন-কোরামিন বা আইসিইউতে দম ধরে রাখতে পারলেই শুকুর গুজরাচ্ছেন। বেকারত্ব, স্থবিরতা ও বিনিয়োগের এমন ধ্বংসযাত্রা মোটেই অনিবার্য ছিল না। নির্বাচিত, স্থায়ী, সক্ষম সরকার এলে অবস্থার বদল হবে—এমন একটা আশায় তারা অপেক্ষমাণ। এর আগ পর্যন্ত চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বেড়ে হতে পারে ৪.৮ শতাংশ। ২০২৭ সালে সেটা আরো বেড়ে ৬.৩ শতাংশে উন্নীত হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে তারা। কিন্তু বিনিয়োগ, নিয়োগ তথা কর্মসংস্থানের সুসংবাদ নেই। তা বুঝতে বিশ্বব্যাংক বা অর্থনীতিবিশারদ হওয়া জরুরি নয়। সেই বুঝজ্ঞান সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের যেকোনো মানুষেরও রয়েছে।

উচ্চ সুদ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সংকোচনশীল মুদ্রানীতি উদ্যোক্তাদের কাছে বিনিয়োগ বিষ খাওয়ার মতো। এর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, বেকার জনগোষ্ঠী ২৬ লাখ ২০ হাজার। গড় হিসাবে প্রতিবছর ২০-২৪ লাখ কর্মক্ষম মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করে। সেই হিসাব এখন আর খাটে না। চাকরির বদলে চাকরি খোয়ানোর সংখ্যা বাড়ছে। কর্মসংস্থানের বড় জোগান আসে দেশি বেসরকারি বিনিয়োগ থেকে। চৈত্রের কাটালের চেয়েও বেদম খরা সেখানে। যত বেশি বিনিয়োগ, তত বেশি উৎপাদন এবং সেই অনুপাতে সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থান। অর্থাৎ বিনিয়োগ না থাকলে নিয়োগের আশা করাই বাতুলতা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্টস সম্পর্কিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে দেশে নিট প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে মাত্র ২১ কোটি ৩০ লাখ ইউএস ডলারের। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৭৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় নিট এফডিআই ৫৩ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৭১.৩৭ শতাংশ কমেছে। স্থানীয় বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা দেশেই থাকে। তা পুনর্বিনিয়োগ হয়। নিয়োগও বাড়ে। সেখানে দেশ বিশেষ করে বেসরকারি খাত এখন উল্টারথে। কর্মদাতারাই কর্মহীন হতে থাকলে, অস্তিত্ব নিয়ে বেতাল থাকলে নিয়োগ বিদেশ বা আকাশ থেকে পড়বে না।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।