ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচন নিয়ে এখন হাজারো গুজব, পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনরুত্থানের উন্মত্ত প্রচেষ্টা, ইতিহাস সৃষ্টিকারী গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর বিরোধ, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন দলের নানা দাবি সামনে আসছে।
জুলাই সনদ নিয়ে মতবিরোধ, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা আর সর্বোপরি সরকারের দুর্বলতা যেন গুজবের ডালপালাকে এক মহীরুহে পরিণত করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সবার মনে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন— অধ্যাপক ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠকের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে তো, নাকি নানা কৌশলে নির্বাচন দীর্ঘায়িত করে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনরুত্থানের পথকে মসৃণ করা হবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দেশগঠন নিয়ে তার মতামত চাওয়া হয়েছিল। তিনি তৎকালীন সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে শক্তিশালী বিরোধী দল তৈরির পরামর্শ দিয়েছিলেন।
কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের বাইরে কাউকে চিন্তা করতে পারেননি। তিনি বিরোধী মত, সমালোচনা ও নির্বাচনে ভয় পাওয়া শুরু করলেন। এ কারণে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচন তাকে ভোট ডাকাতের তকমা এনে দিয়েছিল। ফলে বাকশাল এবং গণঅভ্যুত্থানের রক্তাক্ত পথে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল।
একইভাবে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করার পুঞ্জিভূত ক্ষোভ জমতে জমতে সুপ্ত ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি হয়েছিল বাংলাদেশ, যার ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয় ২০২৪ সালে ৫ আগস্ট। শেখ হাসিনাকে ভারতে পালিয়ে জীবন রক্ষা করতে হয়।
কিছুদিন আগে আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল। তৎকালীন শাসককে বাংলাদেশের শেখ হাসিনার মতোই পালিয়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু সেখানকার অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত একটি নির্বাচন দিয়ে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ঋণে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা এখন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ হওয়ার পথে।
অন্যদিকে আমরা যদি গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী মিশরের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব সেখানকার পরিস্থিতি ছিল অনেকটা বাংলাদেশের মতো। প্রেসিডেন্ট মুরসি সরকারের কাছে বিরোধী দলগুলোর দাবির অভাব ছিল না। নানা দাবি আর আন্দোলনে সরকার ছিল ভঙ্গুর। ফলে সেনাপ্রধান সিসি অনায়াসে ক্ষমতা দখল করে নেন।
নিকট অতীতের কয়েকটি ঘটনা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলে যায়। দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর, নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে অচলাবস্থা, সচিবালয়ে স্থবিরতা, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নেই, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা, আইন-শৃঙ্খলার বালাই নেই।
এরমধ্যেই অন্তর্বর্তী এই সরকার এক বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। গত এক বছর ধরে বারবার সংস্কার আর বিচারের কথা বলা হচ্ছে। বিচার ও সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কার ও বিচার কখনো জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। সংস্কার কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোর মোটা দাগে সংস্কার বাস্তবায়নেও একমত হয়েছে।
জুলাই সনদও সই করতে সবাই অনেকটা একমত। কিন্তু তারপরও সংস্কার ও বিচারের নামে ১৭ বছর ধরে ভোটাধিকার বঞ্চিত জনগণের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা অনেকটা পতিত শেখ হাসিনার উন্নয়নের ডকট্রিনের মতো। তিনি যেমন বলতেন— আগে উন্নয়ন, পরে ভোটাধিকার। এখনো তেমনটা বলা হচ্ছে— আগে বিচার-সংস্কার, পরে নির্বাচন।
সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্প্রতি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এক্সিট দেখা উচিত। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছিলেন। তার স্বাভাবিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ ছিল রুদ্ধ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের হানিমুন পিরিয়ড শেষ। গত এক বছরের এই সরকারের অনেক উপদেষ্টার বিরুদ্ধেই নানান অভিযোগ আসা শুরু হয়েছে।
সরকারে থাকা ছাত্র উপদেষ্টা ও ছাত্রনেতাদের চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির খবর এখন জনগণের মুখে মুখে। এক ছাত্র উপদেষ্টার বাবার ক্ষমতার অপব্যবহার এখন আর গোপন নেই। এমতাবস্থায় সম্মানজনক প্রস্থান ও জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই কেবল বাংলাদেশকে সঠিক পথে তুলতে পারে।
অনেকটাই বেশি ইতিহাস সচেতন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জানেন মার্কিন সমর্থনপুষ্ট হয়ে হামিদ কারজাই আফগানিস্তান পুনর্গঠনে কাজ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন কীভাবে। মার্কিন বাহিনীর হামলার পর ইরাক তছনছ হয়ে যায়। পুনর্গঠন আর হয়নি। সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতনের পর নতুন এক গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি সিরিয়া।
কীভাবে শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেই উদাহরণ রয়েছে আমাদের সামনে। দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা কীভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়েছিলেন, সেই উদাহরণও আছে। কিন্তু নিকট প্রতিবেশী মিয়ানমারের নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির পরিণতিও আমরা দেখেছি।
এসব উদাহরণ আমলে নিয়ে অধ্যাপক ইউনূস সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন, এমনটি আশা করা যায়। বাংলাদেশের সমাজ-বাস্তবতা ও রাজনৈতিক ইতিহাস এই সিদ্ধান্ত নিতে তাকে সহায়তা করবে। তবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো— আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না।
আরএইচ