বর্তমান সভ্যতায় মানুষের ব্যবহার্য উপাদানসমূহের মধ্যে জুতা অন্যতম। জুতা উদ্ভাবন হয়েছিল মানুষের পায়ের পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য।
জুতাকে প্রমিত বাংলায় পাদুকাও বলা হয়। পায়ের সঙ্গে জুতার নিবিড় সম্পর্ক থেকেই ‘পাদুকা’ নামকরণ। পাদুকা পা কে কাদা-পানি, ময়লা-আবর্জনা থেকে রক্ষা করে, পরিচ্ছন্ন রাখে। শতকোটি টাকার মূল্যবান ধাতু দিয়ে পাদুকা বানালেও তা পায়েই থাকে। কেউ তা মাথায় নিতে চায় না, এমনকি মাথায় ধারণও করে না।
স্থান-কাল-পাত্র ও সংস্কৃতি ভেদে জুতার ভূমিকাও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কাউকে জুতা দেখানো মানে তাকে মারাত্মক অপদস্থ করা। একসময় জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে জমিদার পরিবারের বাইরের লোকদের জুতা পায়ে চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষরা জুতাকে যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতেন। তা অত্যন্ত আদর ও যত্নের সঙ্গে হাতে বহন করার রীতিও প্রচলিত ছিল। গ্রামের মোড়ল-মাতব্বরদের জুতা তো চিরকাল উদ্ধতপনার প্রতীক হিসেবে নিরীহ লোকদের পিঠে দণ্ড আখ্যায় ব্যবহৃত হয়েছে। পরিবারের অনেক রাগী অভিভাবক অশিষ্টদের শায়েস্তা করতে জুতা ব্যবহার করতেন। যুগে যুগে বেহায়া, বেয়াদব, এমনকি অপরাধীদের পর্যন্ত জুতা মেরেই শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হতো। জুতা ছিল সতর্কতার বার্তা। যুগ যুগ ধরে দুর্বলের বিরুদ্ধে সবলরা জুতা ব্যবহার করে আসছেন।
সময়ের পরিক্রমায় স্থান ও সমাজভেদে জুতার ভূমিকা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। আমাদের দেশে কোনো ইবাদত বা উপাসনালয়ে জুতা পায়ে প্রবেশ করা যায় না। জুতার অনেক মাহাত্ম্য থাকা সত্ত্বেও এক অজ্ঞাত কারণে জুতা দেখানো, জুতাপেটা, জুতার মালা পরানোকে খুব খারাপ চোখে দেখা হয়। জুতা চোরকে যেভাবে অপমানিত হতে হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাৎ করলেও এত অপমানিত হতে হয় না। কোনও কোনও উন্নত দেশে জুতা দিয়ে পানীয় পান করার এক বিতর্কিত প্রথা চালু আছে, যা ‘শুই’ নামে পরিচিত। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ান সংস্কৃতিতে এটি উদযাপন বা উল্লাসের একটি অংশ হিসাবে কখনও কখনও ক্রীড়া বা সঙ্গীত উৎসবেও দেখা যায়। যদিও এটি একটি ঐতিহ্য, এটি সাধারণত ঘটে যখন কেউ কোনও বিশেষ ঘটনা বা বিজয় উদযাপন করতে চায়। এর জন্য, ব্যক্তি হয় নিজের জুতা খুলে ফেলেন বা বন্ধুর জুতা ব্যবহার করেন।
জার্মান সেনাবাহিনীতে অন্য সৈনিকের বুট থেকে মদ্যপান করা ছিল একটি ঐতিহ্যবাহী রীতি এবং সৈন্যরা বিজয়ের পর জেনারেলের বুট থেকে মদ্যপান করতো। জুতা বা বুট থেকে মদ্যপান সৌভাগ্য বয়ে আনতে পারে এই ধারণাটি মধ্যযুগ থেকে শুরু হয়েছিল। জার্মান ‘বিয়ারস্টিফেল’ হচ্ছে একটি বুট আকৃতির বিয়ার গ্লাস যা একজন জেনারেল একটি নামহীন যুদ্ধে তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়, যিনি তার সৈন্যদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে- যদি তারা আসন্ন যুদ্ধে জয়ী হয়, তাহলে তিনি তার নিজের বুট থেকে বিয়ার পান করাবেন।
এদেশে জুতার মালার সংস্কৃতি দীর্ঘদিন থেকে চালু আছে। তবে বর্তমানে যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে তা খুবই বিপজ্জনক। উচ্চপদে আসিন থেকে ঊর্ধ্বতনের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করে সরকার থেকে ফুলের মালা পেলেও সর্বসাধারণের কাছে তা যদি গ্রহণযোগ্যতা না পায়, তাহলে তার জন্য প্রস্তুত থাকে জুতার মালা। আবার উচ্চপদে থেকে যদি বিবেকের তাড়নায় বা সর্বসাধারণের জন্য কাজ করে; তখন জুতার মালা না পড়লেও আয়না ঘরে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
বিশ্বের অনেক দেশে প্রতিবাদের রূপে ভিন্নতা রয়েছে। অপমান হিসেবে জুতা নিক্ষেপ প্রাচীনকাল থেকেই শুরু হয়েছে। আমাদের দেশে গলায় জুতার মালা পরানো অপমানজনক এবং সেই সাথে আইনের দৃষ্টিতে তা একটি অপরাধ। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হলো- ব্যক্তির পদমর্যাদার যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করা। যখন একজন বিশিষ্ট নাগরিক এভাবে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত হতে পারেন, তখন সাধারণ নাগরিকের মর্যাদা কতটা সুরক্ষিত, তা বলাই বাহুল্য।
জু-তা মাত্র দুটি অক্ষর, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক জোরালো প্রতীক। ঘুষ, দুর্নীতি, ধর্ষণ, অত্যাচার, মিথ্যাচার, নিযার্তন সহ সকল অবৈধ ও অন্যায়ের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরের পাশাপাশি জুতার মালাও প্রতিবাদের নিদর্শন হিসাবে যুক্ত। প্রকাশ্যে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার খবর সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকসময় ভিডিওতে দেখা যায়, কিছু লোক তাঁকে ঘিরে আছেন, পেছন থেকে কেউ পেটাচ্ছেন আর অন্যরা চারপাশে জড়ো হয়ে উল্লাস করছেন। কেউ দাবি তুলছে পুরো এলাকায় বা জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে বা কেউ বলছে এলাকা ছাড়তে। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনাকে যুক্তিসঙ্গত ন্যায্যতা দিয়ে সমর্থন করে তার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শনের চেষ্টাও করছেন অনেকে।
প্রায় সকল সময়েই এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় কিন্তু কোন প্রতিকার হয় না। গলায় জুতার মালা, কোমরে দড়ি বেঁধে নেওয়ার ছবি বেশ ভাইরাল হয়৷ অনেক সময় পুলিশ সদস্যরা পাশে নির্বিকার চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকেন। দেখে মনে হয়, জুতা পরানোর কাজই যেন পাহারা দিচ্ছেন!
রাজনৈতিক পট পরির্বতনের সাথে সাথে বিপরীত মতাদর্শের রাজনীতি করার কারণে, অনেক সময় এমন লজ্জাজনক ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। আবার কখনোবা শ্লীলতাহানির অভিযোগেও গলায় জুতার মালা পরানো হয়। যার গলায় জুতার মালা; তিনি হয় মুক্তিযোদ্ধা, অথবা আলেম, নতুবা একজন শিক্ষক। তবে বিষয়টাকে মুক্তিযোদ্ধা, আলেম বা শিক্ষক হিসাবে ফলাও করে প্রচার করা হয় কেন ! মুক্তিযোদ্ধা, আলেম বা শিক্ষক হয়েছে তাতে কি? তিনি তো আইনের ঊর্ধ্বে নন। তিনি যদি অপরাধী হয়ে থাকেন, আইন অনুযায়ী আজ বা কাল শাস্তি তাঁকে পেতেই হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা অথচ তার নামে হত্যা মামলাসহ অনেকগুলি মামলা আছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা কিভাবে হত্যা মামলার আসামি হতে পারে? আলেম বা শিক্ষক কিভাবে শ্লীলতাহানির সাথে জড়িত থাকতে পারে ! তাতো কেউ প্রশ্ন তুলে না। আলেম-শিক্ষক- মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট লাগিয়ে অপকর্ম করে ঘুরে বেড়াবে, আর কিছু বলা যাবে না, তা কিভাবে হয়? তবে এটাও ঠিক, আইন নিজের হাতে তুলে নিলে বা একটি অপরাধকে স্বীকৃতি দিলে এই ধরনের অপরাধ আরও বাড়বে।
শিক্ষক বা মুক্তিযোদ্ধার গলায় যে জুতার মালা স্থান পেল সেটার দায়ভার কার? যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিজেদের দলীয় পণ্য বানায়, তার দায় অবশ্যই সেই রাজনৈতিক দলের। গলায় জুতার মালা পরানোর একটা প্রতীকী তাৎপর্য আছে। দীর্ঘদিনের ক্ষোভ পুষে রাখা এক গোষ্ঠী হয়তো মনে করছে এটাই প্রতিশোধ নেওয়ার যথার্থ সময় ও পন্থা। আজকের এমন বাংলাদেশ কারোই প্রত্যাশিত না। বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে এমনভাবে বিভক্ত করা হয়েছে যে, তারা অতি সহজে বলতে পারে- হয় তুমি আমাদের, না হয় ওদের! স্রোতের বিপরীতে কোনো কথা বললেই বিশেষ কোনো দলের তকমা সেটে যাওয়ার ভয় কাজ করে মুক্তচিন্তার মানুষদের মনে। আর তাই চুপ থাকাকেই নিরাপদ মনে করেন অনেকে।
আইন হাতে তুলে নেওয়া মানে, দেশে কোনও আইনের শাসন নেই যা সমাজের শিষ্টাচার, মূল্যবোধ ও সামাজিক বিধির ওপর কঠিন আঘাত। দোষ করলে আইনের আওতায় আনা হোক। বিচার হওয়া উচিত প্রচলিত আইন অনুযায়ী, এইভাবে অপমান কোনভাবেই কাম্য নয়। দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা সভ্য হতে পারলাম না। যা হচ্ছে তা ভবিষ্যতের জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হচ্ছে। যে অপসংস্কৃতি শুরু হয়েছে, তা চলবে, চলতে থাকবে, আগামিতেও হবে এবং ভয়ংকরভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয় হতে হতে কবরে শায়িত হবে।
অপরাধ করলে শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে কিন্তু এই ধরনের শাস্তিতো অপমানজনক, যা একজন মানুষকে তার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্তরা সরকারের অদেশ/অভিপ্রায় পালন করতে অনেক সময় বাধ্য থাকেন। যে কারণে গলায় জুতার মালার চেয়েও ভয়ানক কিছু তাদের কপালে জুটে থাকে। বিনা বিচারে মারধর ও জুতার মালা পরানো মানে তার স্ত্রী-সন্তানদের মানসিকভাবে হত্যা করা।
রাষ্ট্র ক্ষমতার অপব্যবহার, ধর্ষণ, ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে গলায় জুতার মালা পরানো এ দেশে কোনো নতুন ঘটনা নয়। মুক্তিযোদ্ধা, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা শিক্ষক যেই হোন না কেন তাঁর বিরুদ্ধে যদি জুতা ব্যবহার করা হয়, তা সীমাহীন নৈরাজ্যেরই বহিঃপ্রকাশ। ব্যক্তির গলায় জুতার মালা- এটা একজন ব্যক্তির মানবিক ও সামাজিক অবস্থানকে ধ্বংস করে ফেলে। এটাকেই বলে অমানবিকীকরণ। একজন সর্বোচ্চ অপরাধীরও অধিকার সংরক্ষিত থাকা উচিৎ। কোনো অপরাধীর ফাঁসির আদেশ হলে তারও কিছু মানবিক অধিকার থাকে। ফাঁসির পূর্বে অন্তিম ইচ্ছাপূরণের বাধ্যবাধকতা আইনেই উল্লেখ আছে। গলায় জুতার মালা দিয়ে তার নাগরিক অধিকার হরণ করা হত্যা করার শামিল। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই দণ্ড প্রদান করা হলো। হয়তো নিয়মিত বিচার ব্যবস্থা তার বিপক্ষে হতে পারতো।
সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না, কিংবা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারো সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। ’ দেশের বিদ্যমান বিচারব্যবস্থায় কোনো নাগরিক যদি কোনো কারণে সংক্ষুব্ধ হন, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অন্যায় আচরণের শিকার হন, এর প্রতিকারের জন্য তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। বিচার করার একমাত্র এখতিয়ার আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আদালতের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। সুশাসন নিশ্চিতকরণের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনও বিকল্প নেই।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি।