ঢাকা, সোমবার, ২০ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৯ সফর ১৪৪৭

মুক্তমত

ঘাপটি মেরে আছে অদৃশ্য ‘ঘুষ সংস্কৃতি’

মীর আব্দুল আলীম, সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ |
আপডেট: ০৮:৫৮, আগস্ট ৪, ২০২৫
ঘাপটি মেরে আছে অদৃশ্য ‘ঘুষ সংস্কৃতি’ মীর আব্দুল আলীম

ঘুষ, দুর্নীতি বাংলাদেশে এখন এক অমোঘ বাস্তবতা। শোনা যায়, ঘুষের বাজারে মন্দা নেই, বরং নিত্যপণ্যের মতোই এরও একটা দর তালিকা আছে, প্রতি দপ্তরে, প্রতি চেয়ারে! যেন রাষ্ট্রব্যবস্থার ভাঁজে ভাঁজে ঘাপটি মেরে বসে আছে এক অদৃশ্য ‘ঘুষ সংস্কৃতি’।

বাংলাদেশে এখন ঘুষ একটা ‘বিকল্প অর্থনীতি’র মতো। কেউ কেউ বলে, এটা নাকি একটি ‘অফিশিয়াল অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো’, যা ছাড়া অফিস চলে না।

এটি এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে কেউ ঘুষ ছাড়াই সরকারি কোনো সেবা পেয়ে গেলে অবাক হয়ে যায়। কোনো দেশে ঘুষ যদি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়, তাহলে সেখানে সামাজিক চুক্তি ভেঙে পড়ে। নাগরিক আর রাষ্ট্রের মধ্যে যে আস্থার বন্ধন থাকে, তা চূর্ণ হয়। ঘুষ দিয়ে গড়া রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার বলতে কিছু থাকে না, সেখানে থাকে শুধু ‘দয়া’।

সরকারি প্রকল্প হোক বা বেসরকারি টেন্ডার, বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হোক বা শহরের ম্যানহোল পরিষ্কার—সবখানেই একটা ‘অদৃশ্য কমিশন’ নির্ধারিত আছে। জন্মনিবন্ধন থেকে মৃত্যু সনদ, স্কুলে ভর্তি থেকে চাকরিতে নিয়োগ, এমনকি হাসপাতালের সিট পেতে গেলেও ‘গিফট কালচার’ বা ‘ব্যবস্থাপনার’ শরণাপন্ন হতে হয়। দুর্নীতির এই বিস্তৃতি দেখলে মনে হয়, এটা আর কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, বরং আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির অংশ। অনেক তরুণ এখন এটাকে আর অপমানজনকও মনে করে না।

এটা যদি প্রজন্মের চেতনায় ঢুকে যায়, তাহলে আমরা কিভাবে বলব—এই রাষ্ট্র নৈতিকতার ওপর দাঁড়িয়ে?

ঘুষ-দুর্নীতির কারণ—১. নৈতিকতার অভাব; ২. দুর্বল আইন ও প্রয়োগের দুর্বলতা; ৩. জবাবদিহির অভাব; ৪. নিম্ন বেতন ও উচ্চ ব্যয়; ৫. রাজনৈতিক প্রভাব!

৫ আগস্টের পর ভেবেছিলাম, সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো ঘুষ কি কমেছে? কমেনি, বরং বেড়েছে। বিআরটিএ, ভূমি অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, পুলিশ স্টেশন, আদালতপাড়াসহ সবখানেই অনেকটা রাখঢাক না রেখেই ঘুষ গ্রহণ চলছে। ঘুষ দেওয়া বা ওেয়া সমাজে এক অনিবার্য বিধান যেন। ঘুষহীনতা মানেই এখন অস্বাভাবিক কিছু।

ঘুষহীন অবস্থাটা সেবা না পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে।

পলিসিটা ভালো! যত হয়রানি তত ঘুষের অঙ্ক বাড়ে। তাই অনেক অফিসে অহেতুক লম্বা লাইনে দাঁড়ানো কিংবা কাজের সিরিয়াল থাকে। বিশেষ করে পাসপোর্ট অফিস আর বিআরটিএতে এ দৃশ্য কমন। কাজের ব্যাপ্তি অনুসারে ঘুষের পরিমাণ নির্ধারিত কোনো কোনো দপ্তরে। সেবাপ্রাপ্তি নাগরিক অধিকার। এ অধিকার অনেকটাই হরণ করেছে ঘুষ-দুর্নীতি। এক পরিসংখ্যান বলছে, ঘুষের পরিমাণ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

সেবা খাতের কোথাও দুর্নীতি কমেছে এমন কথা শোনা যায়নি। সেবা খাতের ভুক্তভোগী মাত্রই জানে, ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। দুর্নীতির এই চিত্র যে কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তার উদাহরণ উঠে এসেছে টিআইবির চলতি প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, ঘুষ ছাড়া সেবাপ্রাপ্তি এখন প্রায় দুরূহ। পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি দুর্নীতি আছে, ঘুষের রেওয়াজ আছে। এই কথাটির আপেক্ষিক সত্যতা মেনে নিয়েও বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় দুর্নীতির ব্যাপকতাকে অস্বীকার করার কোনো অজুহাত নেই।

টিআইবি দেশের ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাতের ওপরে জরিপ করে দুর্নীতি ও ঘুষের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রশাসন, ভূমি, কৃষি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বিআরটিএ, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, বীমা, গ্যাস সেবা খাতে এই জরিপ করেছে টিআইবি। জরিপে বলা হয়, দেশের ৮৯ শতাংশ মানুষ মনে করে, ঘুষ না দিলে কোনো সেবা মেলে না। জরিপের তথ্য মতে, গত বছর সার্বিকভাবে ঘুষের শিকার (ঘুষ দিতে বাধ্য) হওয়া খানার হার ৪৯.৮ শতাংশ।

সার্বিকভাবে দেখলে দুর্নীতির ব্যাপকতার সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটি সম্পর্ক আছে। এ কথার সত্যতা স্বীকার করে নিয়ে বলতে হয় যে শুধু মূল্যবোধের অবক্ষয় বাংলাদেশের দুর্নীতির ব্যাপক প্রসারের প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা জনগণের মনে যে পরিমাণ হতাশার সৃষ্টি করে তা তুলনাহীন।

সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা দেশের জনগণের মনে তীব্র হতাশার সৃষ্টি করেছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে সৃষ্টি করেছে বাধা। যত দিন এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভূমিকা কার্যকরভাবে পালন করতে পারবে না, তত দিন সমাজে দুর্নীতির ব্যাপক দৌরাত্ম্যের প্রতাপ আমাদের দেখে যেতে হবে। দুর্নীতির যে ধারণা আমরা সৃষ্টি করেছি, সেই ধারণাকে বদলাতে হবে আমাদেরই। আর তা করতে হবে কথাকে কাজে পরিণত করার মাধ্যমে। বেশির ভাগ সময়ই যারা দুর্নীতি করে তারা পার পেয়ে যায়। দুর্নীতির অভিযোগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমলে নেওয়া হয় না, দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শাস্তি পায় না। ফলে দুর্নীতি রোধ করাও সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

সংক্ষেপে দুর্নীতি বন্ধের কিছু কার্যকর উপায় হলো : (১) শক্তিশালী আইন ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা; (২) সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দায়িত্বের হিসাব নিশ্চিত করা; (৩) ই-গভর্ন্যান্স, অনলাইন টেন্ডারিং, ডিজিটাল পেমেন্ট চালু করে দুর্নীতির সুযোগ কমানো; (৪) রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, শক্তিশালী ও সক্রিয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক); (৫) দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা ও নৈতিক শিক্ষার প্রসার; (৬) দক্ষ, নীতিবান ও প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা নিয়োগ এবং পুরস্কার-প্রণোদনার ব্যবস্থা; (৭) ‘হুইসেল ব্লোয়ার’দের নিরাপত্তা ও উৎসাহ প্রদান।

দেশের আমজনতার মনে ‘বাংলাদেশ একটি প্রধান দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ’—এই ধারণাটি সৃষ্টি হয়েছে। কারণ রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর ভূমিকা পালনের অবকাশ রাখেনি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু ক্ষেত্রে ঘুষ ও দুর্নীতি কমিয়ে আশার আলো দেখাচ্ছে। হাল ছাড়লে চলবে না। এর প্রতিকার অসম্ভব নয়। দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সামাজিক প্রতিরোধ। আমরা যদি হাল ছাড়ি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি পচা সমাজ দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যদি সবাই ‘না’ বলতে শুরু করি, তবে পরিবর্তন হবেই। আমরা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি এবং এ আশায় বুক বাঁধতে চাই। এ দেশ দুর্নীতিমুক্ত হোক—এই প্রত্যাশা আমাদের।

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।