ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

অনলাইন সংবাদমাধ্যমের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দৈনিক পত্রিকা

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১৪
অনলাইন সংবাদমাধ্যমের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দৈনিক পত্রিকা

নতুন নতুন আবিষ্কারসহ দুনিয়াজুড়ে তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতি ঘটছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক যোগাযোগসহ ব্যবসায়িক ও বাজার অর্থনীতির বিচিত্র কার্যক্রম-ডিলিংস অনলাইন বা ইন্টারনেট মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

মোবাইল ফোন ও এর উন্নত নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের ফলে ইন্টারনেটের ব্যবহারকে আরো বেশি গতিশীল ও সম্প্রসারিত করেছে। এতে করে অনলাইনে গড়ে উঠেছে মানুষের কাছে দ্রুত ও তাৎক্ষণিক সংবাদ পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম। যাকে বর্তমানে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বলা হয়। বিশ্ব্যব্যাপী প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান ও নিউইয়র্ক টাইমসসহ পশ্চিমা দুনিয়ার বেশ কয়েকটি দৈনিক তাদের কাগজে ছাপা মাধ্যম থেকে সরে পুরাপুরি যুক্ত হয়েছে অনলাইন মাধ্যমে। তবে পত্রিকা দুটির সরে আসার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক ব্যয়ের বিষয়টি বড় কারণ ছিল।

এছাড়া ছাপা মাধ্যম থেকে সরে না আসলেও অন্যান্য সব ধরনের দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকাগুলোও পাল্লা দিয়ে নিজস্ব ওয়েবসাইট খুলে অনলাইন সংস্করণে যুক্ত হয়েছে।

প্রথম দিকে যখন রেডিওর পর টিভি সম্প্রচার মাধ্যম শুরু হল, তখন এতে করে দৈনিক পত্রিকার পাঠক সংখ্যা কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। তবে ইন্টারনেট ভিত্তিক সংবাদপত্র চালু হওয়ার পর থেকে এ আশঙ্কা অনেক বেশি বেড়ে যায়। বর্তমানে ইন্টারনেট বা অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়েছে। দিন দিন এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।   online_news

টিভির চেয়েও খুব দ্রুত এবং যেকোনো ঘটনার খবর তাৎক্ষণিকভাবে প্রচার করছে অনলাইন পত্রিকাগুলো। এতে করে পত্রিকার পাঠকের সংখ্যায় বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে, সন্দেহ নেই। অপরদিকে মোবাইলে নেট ব্যবহারের সুবিধা থাকায় অনলাইন পত্রিকার চাহিদাও অনেকগুণ বেড়েছে।

এ পরিস্থিতিতে যখন বহু পাঠকের তীব্র ঝোঁক অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের দিকে, তখন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো পড়েছে বিরাটরকমের উভয়সংকটে। একদিকে নতুন পাঠক শ্রেণি গড়ে তুলছে অনলাইন খবরওলারা। অপরদিকে আরেকটি পাঠক শ্রেণি আছে, যারা পুরনো সংবাদমাধ্যম দৈনিক পত্রিকাতেই সন্তুষ্ট। এই পুরানা শ্রেণিটা মূলত দৈনিক পত্রিকার এবং নিউজ চ্যানেলগুলোর।

অনেকে মনে করছেন, সংবাদ মাধ্যমের দৈনিক থেকে অনলাইনের দিকে আসার পেছনে প্রযুক্তিগত সুবিধা, কম পুঁজি ও সহজলভ্যতার বিষয়টিই একমাত্র কারণ নয়। তুলনামূলক দ্রুত সময়ে একটি অনলাইন সংবাদ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের বিষয়টি প্রধান কারণ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু একটি সর্বাত্মক ও সম্পূর্ণ অনলাইন সংবাদমাধ্যম গড়ে তুলতে দৈনিক কিংবা টিভি মাধ্যমের চেয়ে খরচ কম হয় না।    

কিন্তু কোন মাধ্যম কত কম খরচে করা যায়— বাজার বিশেষজ্ঞদের এসব যুক্তি-পাল্টা যুক্তিতে একেবারেই আগ্রহ নাই। মূলত দৈনিক না করে কেউ যখন অনলাইন করছে, তাতে দৈনিকের চেয়ে অনলাইনে বেশি আয় হচ্ছে কি-না এটাই তাদের আগ্রহ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো প্রচলিত দৈনিক পত্রিকা যে পরিমাণ আয় করে তার খুবই ছোট একটি অংশ আয় করতে পারে। তারা মনে করছেন, খুব বেশি এ  মাধ্যমটি এখনো অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার মত জায়গায় যায়নি।

তবে বেশ কয়েকবছরে ইউরোপ ও পশ্চিমা দুনিয়ায় অনলাইন বিজ্ঞাপনদাতাদের বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ছিল। তাতে করে অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো বেশ ভালো আয় করতে সক্ষম হয়। ২০০৮ ও ০৯ সালে হঠাৱ বিজ্ঞাপন কম আসায় অনলাইন সংবাদমাধ্যমের এই আয়ের ধারার নাটকীয় পতন ঘটে।

ওই দুই বছরে প্রথমসারির অনলাইন পত্রিকাগুলোতে ভাল অবস্থা না থাকলেও মোটামুটি একটা অবস্থানে থাকে। এর নিচের সারির পত্রিকাগুলোতে আয় ক্রমাগত কমতে থাকে। পরবর্তীতে এ অবস্থার উন্নতি ঘটতে শুরু করে। ধারণা করা হয়, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির কারণে হয়ত এমনটি হতে পারে।        

দৈনিক পত্রিকাগুলোর আয় শুধু অনলাইন পত্রিকাগুলোর চেয়ে বেশি হওয়ার আরো কারণ হল, দৈনিক পত্রিকাগুলো তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটেও বিজ্ঞাপন পায়।
অ্যাডভার্টাইজিং এইজ সার্ভে তাদের এক পরিসংখ্যানে দেখায়, দৈনিক পত্রিকাগুলো যা আয় করে, তার ১৫ শতাংশ আসে তাদের নিজস্ব ওয়েব সংস্করণে পাওয়া বিজ্ঞাপন থেকে। তবে ২০০৮ সালে অনলাইন থেকে বিপুল আয় করে লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস।

ওই পরিসংখ্যানে বলা হয়, সে সময় লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস অনলাইনে এতবেশি আয় করে যে, তা দিয়ে পত্রিকাটি তাদের ছাপা ও অনলাইন মাধ্যমের সব সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন দিয়েও তাদের কাছে উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে যায়। অ্যাডভার্টাইজিং এজ সার্ভে জানায়, ২০০৮ সালে ছাপা মাধ্যমের সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক সাময়িকীগুলোও তাদের অনলাইন থেকে ১০ শতাংশ আয় করে।  

অনলাইন থেকে আয়ের এই চিত্র তুলে ধরে পরিসংখ্যানবিদরা বলছেন, এই আয়ই দৈনিক পত্রিকাগুলোর জন্য যথেষ্ট নয়। বর্তমানে যে পাঠক সংখ্যা আছে তা দিয়ে দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকীগুলো তাদের অর্থনৈতিক ব্যয়ের চাহিদা মেটাতে পারবে না। আয় বাড়াতে হলে পাঠক সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নাই। মোটকথা অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোর উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় দৈনিক পত্রিকার টিকে থাকার অর্থনৈতিক সক্ষমতা নিয়ে আশঙ্কা বোধ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পরিসংখ্যান সংস্থাটি এই সংকটের কারণ সম্পর্কে জানায়, অনলাইনমাধ্যমের কারণে সমাজের নানান শ্রেণীতে দৈনিক পত্রিকার পাঠক সংখ্যার যে গড় ছিল তার উপর নেতিবাচক পড়েছে।

বিশেষত কিশোর বয়স থেকে শুরু করে তরুণ ও যুবক শ্রেণীর মধ্যে অনলাইনের পাঠকপ্রিয়তা সবেচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে একেবারে কিশোর বা টিনএজের ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে বেশি অনলাইন পত্রিকার দিকে ঝুঁকছে। ফলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বর্তমানে যুবক ও তারো বেশি বয়সের প্রজন্মের কালপর্ব শেষ হলে
এই কিশোর প্রজন্মের মধ্য দিয়ে যে ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে সে সময় দৈনিক পত্রিকার প্রভাব কমে যেতে পারে। তারা বলছেন, এরজন্য প্রিন্ট মিডিয়ার টিকে থাকার জন্য দীর্ঘ মেয়াদী কৌশল নির্ধারণ করা জরুরি।     

পিউ রিসার্চ সেন্টার ফর দ্য পিপল এন্ড দি প্রেস জানায়, ২০০১ সালে টেলিভিশন মিডিয়ার পাঠক সংখ্যা ছিল ৭৪ শতাংশ। তবে ২০০৮ সালে তা নেমে আসে ৭০ শতাংশে। ২০০২ সালে শুধু টেলিভিশন মিডিয়ার পাঠক সংখ্যা ছিল ৮২ শতাংশ। এই আট বছরে এটাই ছিল সবচেয়ে বেশি পাঠক সংখ্যার বছর।
অপরদিকে ২০০১ সালে দৈনিক পত্রিকার পাঠক সংখ্যা ছিল ৪৫ শতাংশ। ২০০৮ সালে এ সংখ্যা নেমে আসে ৩৫ শতাংশে।

পাশাপাশি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের প্রায় প্রথম দিকে ২০০১ সালে তাদের পাঠক সংখ্যা ছিল গড়ে ১৩ শতাংশ। কিন্তু ২০০৮ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ৪০ শতাংশে উঠে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিভি বা সম্প্রচার মিডিয়ার পাঠক সংখ্যার উপর অনলাইন মাধ্যম খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না। কিন্তু শুরু হওয়ার মাত্র আট বছরের ব্যবধানে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের প্রভাবের কারণে দৈনিক পত্রিকার পাঠক তুলনামূলকভাবে ৫ শতাংশেরও বেশি কমে যায়।     

সংস্থাটি বলছে, আগের চেয়ে বর্তমানে মানুষ বেশি সংবাদ পড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নব্বইয়ের দশকে যে পরিমাণ পাঠক সংবাদ পড়ত বর্তমানে এ সংখ্যা অনেক বেশি। এর প্রধান কারণ অনলাইন পত্রিকার উপস্থিতি।

নব্বইয়ের দশকে টিভির দর্শক ছিল সর্বোচ্চ ৬৮ শতাংশ। যেটা পরে আরো কমে যায়। দৈনিক পত্রিকার পাঠক সংখ্যা ছিল ৫৬ শতাংশ। পরে তা কমতে কমতে ৩৫ এ নেমে আসে।

অপরদিকে মাত্র সাত বছরে অনলাইন পাঠক সংখ্যা বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।     

২০১০ সালে সংস্থাটি ৭০ মিনিটের একটি পরিসংখ্যান করে। যার সময়কাল হল ১৯৯৪ থেকে ২০১০। তাতে দেখা যায়, ১৯৯৪ সালে রেডিওতে খবর শুনতে একজন শ্রোতা প্রায় ৪৫ মিনিট ব্যয় করত। পরে ২০১০ সালে ওই পাঠক পত্রিকায় খবর পড়তে ব্যয় করে মাত্র ১৫ মিনিট।

১৯৯৪ সালে একজন দর্শক টিভিতে খবর দেখতে ১৫ মিনিট ব্যয় করত। কিন্তু ২০১০ সালে এসে টিভি দর্শক খবর দেখার জন্য ৩২ মিনিট সময় দিচ্ছে।

অপরদিকে ১৯৯৪ সালে একজন পাঠক দৈনিক পত্রিকা পড়তে গড়ে ৬০ মিনিট সময় ব্যয় করত। কিন্তু ২০১০ সালে দেখা যায় একজন পাঠক দৈনিক পত্রিকা পড়তে মাত্র ১০ মিনিট সময় ব্যয় করেছে। ধারণা করা হচ্ছে বর্তমানে এ সময় আরো কমে গেছে। পাশাপাশি ২০০৪ সালে দেখা যায়, অনলাইনে একজন পাঠক খবর পড়তে গড়ে প্রায় ৬ থেকে ৭ মিনিট সময় দিত। ২০১০ সালে একই পাঠক অনলাইনে খবর পড়তে ১৩ মিনিটেরও বেশি সময় দিচ্ছে।

তুলনা করে দেখা যায়, দৈনিক পত্রিকায় খবর পড়তে পাঠক দিন দিন সময় কমিয়ে দিচ্ছে। অপরদিকে তারা ক্রমেই অনলাইনমুখি হয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে অনলাইনে পাঠক আগে যেভাবে সময় দিত খবর পড়তে এখন তার চেয়ে অনেক বেশি সময় দিচ্ছে। যেখানে দৈনিক পত্রিকা পড়তে পাঠক সময় দিচ্ছে ১০ মিনিট, অনলাইনে সময় দিচ্ছে ১৩ মিনিটেরও বেশি। এটি ২০১০ সালের পরিসংখ্যান। প্রায় চার বছর পর বর্তমানে অনলাইনে একজন পাঠক নিশ্চয়ই আরো বেশি সময় দিচ্ছে।     

এ পরিস্থিতিতে দৈনিক পত্রিকার মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের সুনির্দিষ্ট পাঠক শ্রেণী আছে, যারা প্রচলিত মাধ্যমেই খুশি। তারা কখনো অনলাইনে যেতে চাচ্ছে না। কিন্তু বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদিয়মান নতুন প্রজন্ম যেহেতু অনলাইনের প্রধান পাঠক, সেকারণে তদের পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে যে ধারা গড়ে উঠবে তা খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এতে করে দৈনিক পত্রিকার জন্য অনলাইন সংবাদ যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।     

পিপল প্রেস ও মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বার্কলে অবলম্বনে শাহাদাৎ তৈয়ব 

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১৪


     

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।