ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শাহবাগ সত্যি কি ঘুমায়? ।। আদনান সৈয়দ

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৪
শাহবাগ সত্যি কি ঘুমায়? ।। আদনান সৈয়দ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

’গণজাগরণ মঞ্চ ঘুমায়’ শিরোনামে বাংলানিউজের প্রতিবেদনটি চোখে পড়ায় লেখাটির অবতারণা। প্রতিবেদনে দেখা যায়, শাহবাগে গণজাগরণের কর্মীদের রাত ১০টার পর কাউকেই আর দেখা যাচ্ছে না।

পাশাপাশি তাদের সেই আন্দোলনের জোয়ারও আর নেই। আগের মত তরুণদের টানছে না। প্রতিবেদনের প্রতিটা খবর মনেপ্রাণে সমর্থন না করে উপায় নেই। কিন্তু তারপরও শাহবাগ আর গণজাগরণ নিয়ে দুটো কথা বলার জন্যে প্রাণটা ছটফট করছে।

২০১৩ এর ফেব্রুয়ারি আর মার্চের উত্তাল কটা দিন। ভাগ্যক্রমে আমি তখন ঢাকায়। ভাগ্য ভালো এ কারণেই বললাম যে, গণজাগরণের সেই উত্তাল কটা দিন আমিও আন্দোলনের মাঝে আরো হাজারো জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে গা ভাসিয়েছিলাম। চোখের সামনেই শাহবাগ রাতারাতি জনতার সমুদ্রে পরিণত হয়। তরুণরা সেদিন বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত জেগে উঠেছিল। সেই সঙ্গে জেগে ওঠে যেন গোটা বাংলাদেশে।

এখনো চোখ বুজলেই দেখতে পাই শহবাগ চত্বরে লাখো মানুষের ঢল। জোয়ান-বুড়া, যুবক-যুবতী, চার বছেরর কোলের শিশু, সেই মন্টু মিয়া বাদাম বিক্রেতা যিনি বিনামূল্যে বাদাম বিলিয়েছেন, কুলাউরা থেকে আসা আগুনের গোলা ভরা চোখে শফিক, সাভারের অংকের শিক্ষক সিরাজ সরকার, নেত্রকোনা থেকে  ঢাকায় পায়ে হেঁটে আসা চার ভাই। মনে পড়ে তখন সবার চোখে-মুখে, চিন্তায়-ভাবনায়, শ্লোগানে, প্রকাশে, মননে কয়েকটা শব্দমালা খুব স্বাভাবিক ভাবেই যেন জায়গা করে নিয়েছিল, ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই, বাংলাদেশ থেকে জামাত-শিবির নিষিদ্ধ কর’।

কী চাওয়া-পাওয়া ছিল আমাদের শাহবাগের কাছে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত আমাদের তরুণ প্রজন্ম কি দেখতে চেয়েছিল এই শাহবাগের চোখ দিয়ে? মানি, শাহবাগের সেই দৃশ্যমান উত্তাপ হয়তো আজ আর নেই। আবার কেউ কেউ মনে করেন শাহবাগ বুঝি মরে গেছে। কিন্তু সত্যি কি শাহবাগ মরে গেছে? তা কি কখনো সম্ভব? হতে পারে? ফেব্রুয়ারিতে জন্ম নেওয়া শাহবাগের গণজোয়ার আর সেই সঙ্গে টগবগে তারুণ্য কি এত সহজে হার মানতে পারে? এক নদী রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় এই স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর আমাদের এই তরুণ প্রজন্ম মশাল হাতে শাহবাগকে বুকে আকড়ে ধরে আবার জ্বলে উঠতে চেয়েছিল। গত ৪৩ বছর ধরে হৃদয়ের গহীনে পুষে রাখা সেই দগদগে আগুনের লেলিহান শিখা তারুণ্যের হাতে মশালের আগুনের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে শাহবাগে ঠাঁই করে নিয়েছিল। আমাদের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল যখন পুরোপুরি দেউলিয়াগ্রস্থ, সঠিক নেতৃত্রহীনতায় গোটা জাতি যখন দিশেহারা, জামাত-শিবিরের তাণ্ডবে প্রিয় স্বদেশ যখন ক্ষত-বিক্ষত, ঠিক সেই সময়ে, হ্যাঁ ঠিক সেই মোক্ষম সময়ে আমাদের তরুণরা। আমার দেশের সকল দেশপ্রেমিক জনগণ এই বিস্ফোরিত শাহবাগের ছায়ায় তাদের আশ্রয় খুঁজে পেতে চেয়েছিল। আর সেই কারণেই শাহবাগ শুধুমাত্র একটি আন্দোলনের নাম না হয়ে তা গোটা বাংলাদেশের মানুষের আত্মার ঠিকানায় পরিণত হতে সক্ষম হয়।

স্পষ্ট মনে আছে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে কোন রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতি ছিল অনাহুত। শাহবাগ কোন দলের ছিল না। শাহবাগ ছিল গোটা বাংলাদেশের মানুষের আস্থার ঠিকানা। শাহবাগ ছিল সেই সব মানুষের সম্মিলিত কন্ঠস্বর যারা যু্দ্ধপরাধীদের ফাঁসির দাবী চেয়েছিল, যারা বাংলাদেশের মাটি থেকে জামাত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। হায়! সেদিন আমার এক বন্ধু আমাকে দেখে খুব দুঃখের সঙ্গে বললেন,‌ ‌‌শাহবাগ হেকড হইয়া গেছে…’। কিন্তু শাহবাগ এর আন্দোলন কি হেকড হওয়া এত সোজা? কারণ এই আন্দোলন ক্ষমতায় যাওয়ার আরো দশটা পাঁচটা আন্দোলনের মতো ছিল না। শাহবাগের তারুণ্যে ছিল ৪৩ বছর ধরে জমে ওঠা আবর্জনা সাফ করার এক দীপ্ত শপথ। গোটা বাঙালি জাতি তাদের এই লালিত জিঘাংসা ৪৩টি বছর পর্যন্ত তাদের ছোট্ট ধমনীতে জিইয়ে রেখেছে। শাহবাগের খরস্রোতা নদীতে সেই সুপ্ত স্বপ্নগুলো আবার জেগে উঠেছিল। তাই শাহবাগ কখনো মরতে পারে না।

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এমন আন্দোলনে কী ফল হল? ঘরে ফসল কি উঠল? এর উত্তরে এ কথাই বলব যে এর ফলন অনেকাংশেই শুরু হয়েছে। যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবীতে বাংলার মানুষ কি ঐক্যবদ্ধ নয়? জামাত-শিবিরের রাজনীতি কি প্রশ্নবিদ্ধ নয়?

আবারো মানছি, শাহবাগে গণজাগরণের কর্মীরা নেই, সেখানে আগের মতন উত্তাপ নেই। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? তাই বলে কি গণজাগরণ মিথ্যে হয়ে যাবে? আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের নতুন প্রজন্ম, আমাদের তরুণরাই হল আস্থার বাতিঘর। শাহবাগ আন্দোলনকে ঘিরে তারুণ্যের চৈতন্যে এবং মননে যে নতুন প্রাণের স্পন্দন দেখা দিয়েছিল এর মরণ হতে পারে না। বাংলাদেশের কুটিল রাজনীতি আর ব্যক্তিস্বার্থের দলাদলিতে হয়তো আন্দোলনের সেই উৎসবমুখর পরিবেশ আর নেই। কিন্তু শাহবাগের স্পিরিট বাংলার তরুণদের বুকের ভেতর ছাইচাপা আগুনের মত কিন্তু ঠিকই ধিক ধিক করে নিত্যই জ্বলছে। শাহবাগ মানেই রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার দীপ্ত এক শপথের প্রতিচ্ছবি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই বাংলাদেশটাকে গড়তে আমাদের বাংলার তরুণরা আজ বদ্ধপরিকর। তারুণ্যের জয় হবেই।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।