ভদ্রলোক খুব কম কথা বলেন। দশটা প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দেন।
ভদ্রলোক ফ্লোরিডাতে আছেন বহু বছর আগেই। বিয়ে করেননি। একা থাকেন আর নিজের কাজের মাঝেই ডুবে থাকেন সারাটা সময়। ওনার সম্পর্কে জানতে পারি তার খালাতো ভাই আমারই বন্ধু শামিমের মাধ্যমে। শুনেতো আমি অবাক! এই যুগে এমন মানুষও আছে? সত্যিকারের মানব প্রেমিক বলতে যা বোঝায় তিনি হলেন তাই। বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গরিব শিশুদের সাহায্য করাই তার পেশা আর নেশা।
বেশ কিছুদিন চাকরি করেন একটা ব্যাংকে। তারপর নিজেই একটা গ্রোসারি আর গ্যাস স্ট্যাশন কিনে সেই আয় থেকে নিজে চলেন আর শিশুদের পেছনে খরচ করেন। বাংলাদেশের যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে তিনি তার সমস্ত কিছু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তবে তিনি যা করেন তা করেন খুব নীরবে, কাকপক্ষীও যেন জানতে না পারে। ফ্লোরিডার হরেক রকম মানবতাবাদী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে কিউবান এবং হাইটির নেশাগ্রস্ত যুবকদের জন্য তিনি অনেক কাজ করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। নিজের ঘাঁটের পয়সা খরচ করে তিনি অনেক নেশায় আক্রান্ত যুবকদের চিকিৎসা করিয়েছেন, সুস্থ করেছেন। তবে শিশুদের জন্য তিনি যেন দয়ার সাগর। তার ড্রয়িংরুমে বিভিন্ন দেশের শিশুদের সঙ্গে তার ছবিই যেন সে কথাটি বার বার বলে দেয়। বিকেলের ফিকে রোদে আমাদের দেখেই মনে হল তিনি যেন একটু বিরক্ত হলেন। শামিম চোখের ইশারা দিতেই আমি আমার পরিচয় দিয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিই। তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই আমাদের বসতে বলে উল্টো দিকের একটা পুরনো চামড়ার সোফায় কাত হয়ে বসে পড়েন। বয়স পঞ্চাশ এর কাছাকাছি হবেই। চোখে-মুখে কোথায় যেন একটা বিরক্তির চিহ্ন। কথা একদম বলেন না। শামিমই আমাদের কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে কিছু চা-বিস্কিটের আয়োজন করতে চলে যায়।
আমি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করি, কিন্তু এই ব্যক্তির সঙ্গে কেন যেন স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম চলেই বরং যাই। আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই বোধহয় তিনি কথা বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি আপনাদের মতো কথা গুছিয়ে বলতে পারি না। কেন এসেছেন জানতে পারি কি?’ আমি যেন এবার চাঁদের নাগাল পেলাম। এইতো মুখ খুলছেন। আমাদের কথার খই ফুটতে শুরু করল। সত্যি বলতে সেদিন এই মৃদুভাষী ব্যক্তিটির সঙ্গে আমার প্রচুর কথা না হলেও আমার জীবনের অনেক ভাবনা-চিন্তায় তিনি যেন নতুন কিছু জুড়ে দিয়েছিলেন।
সময়কে কিভাবে বাঁচিয়ে মানুষের সেবায় নিজেকে উজাড় করে দেওয়া যায় এর মূল মন্ত্রটি সেই ব্যক্তিটি যেন খুব ভালো করেই জানেন। আর জানেন বলেই তিনি বাড়তি কোনো সময় নষ্ট করেন না। অযথা টাকা-পয়সা নষ্ট করেন না। প্রতিদিন এর জন্য একটা সময়সূচি আগে থেকেই তৈরি থাকে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মেপে মেপে তিনি পথ চলেন। অনেক কষ্ট করে জানতে পারলাম যে চট্টগ্রামের অনেক এতিম খানা তার টাকায় চলে। নিজের দেশের বাড়িতে(চট্টগ্রাম)গরিব ছেলেমেয়েদের জন্য প্রতিদিন কাঙালি ভোজ দেন। গরিব আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশির চোখে তিনি হলেন মানব-দরদি এক দেবতা। কিন্তু তিনি তাঁর এই দানের খবর কাউকেই বলতে চান না। বলেন না। এমনকি আমাকেও বিনয়ের সঙ্গে বারণ করলেন উনার নাম যেন লেখায় উল্লেখ না করি। নিজের মতো করেই যেন তিনি তার জীবনের পথটি খুঁজে নিয়েছেন। চলে আসার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে শুধু বললেন, ‘আপ্যায়ন করতে পারলাম না। কিছু মনে করবেন না। আর একটা অনুরোধ, মানুষের জন্য কিছু করেন। যত সামান্যই হোক সেটা। ’ কথাগুলো বলেই তিনি যেন সেই আবার ভুতুড়ে বাড়ির কোনো এক অন্ধকার কামরায় ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলেন।
আমি তখনও মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এরকম মানুষ এই দুনিয়ায় আরো বেশি নেই কেন? কে জানে? হয়তো আছে আমরা তাদের খোঁজ পাই না। মন চাইছিলো কেন যেন বার বার তাঁর এই পবিত্র চরণ দুটো ছুঁয়ে দিতে পারতাম! ধুলায় নিজেকে বিলিয়ে দেই। কারণ এটাতো জানা কথা যে তার এই চরণের প্রতিটি ধুলি কণায় মিশে আছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, ভালোবাসা আর শুধুই ভালোবাসা।
লেখক: প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৪