ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পিয়াস করিমের লাশ নিয়ে রাজনীতি

জাহিদ নেওয়াজ খান, কনট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৪
পিয়াস করিমের লাশ নিয়ে রাজনীতি

৮৬ বছর বয়সী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে যে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ড. পিয়াস করিমের বাবা অ্যাডভোকেট এম এ করিম তুলে দিয়েছিলেন, সে কারণে নিশ্চয়ই তখনকার কিশোর পিয়াস করিমকে দায়ী করা যায় না।

একাত্তরের এপ্রিলে ৮৬ বছর বয়সী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথমেই যে তার দু’ হাত এবং পরে হাঁটু ভেঙ্গে দেওয়া হলো, সেজন্য নিশ্চয়ই পিয়াস করিমকে দোষী করা যায় না।



হাত এবং হাঁটু ভাঙ্গা অবস্থায় পরের দু’ মাস যে বুড়ো মানুষটিকে শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হলো, সে কারণে নিশ্চয়ই পিয়াস করিমকে অভিযুক্ত করা যায় না।

৮৬ বছর বয়সে এরকম নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে যে মাস দুয়েক পর মরে যেতে হলো, সেজন্যও অবশ্যই তখনকার কিশোর পিয়াস করিম দায়ী নন।

এতো বয়স হওয়ার পরও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নির্যাতন এবং মৃত্যু থেকে যে রেহাই পেলেন না, আর বিপরীতে ওইরকম বয়েসী হওয়ার কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধে গোলাম আযম দোষী হওয়ার পরও যে রাজকীয় সেবা-শুশ্রুষা পাচ্ছে; সেজন্যও নিশ্চয়ই পরিণত পিয়াস করিম দোষী নন।

তা হলে পিয়াস করিমের দোষটা কোথায়? তা হলে তার মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে রাষ্ট্রীয় না হোক; অন্ততঃ রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক শ্রদ্ধা জানাতে আপত্তি কেনো?

তার বাবা না হয় প্রাদেশিক পরিষদে প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের পথ ধরেই না হয় শহীদ মিনার। সেই শহীদ মিনারের পথ ধরেই না হয় মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধের পথ ধরেই না হয় বাংলাদেশ। ড. পিয়াস করিম তো সেই বাংলাদেশেরই নাগরিক। তা হলে তার মরদেহ শহীদ মিনারে নিতে সমস্যা কোথায়?

Dhirendra_nath_dattaসমস্যাটা হচ্ছে চেতনাগত এবং দর্শনগত জায়গায়। নানা মতাদর্শের পথ মাড়িয়ে পিয়াস করিম শেষ পর্যন্ত যে দর্শন ফেরি করে গেছেন সেটা ওই শহীদ মিনারের মতাদর্শের পরিপন্থি। নানা ঘাটের জল খেলেও পিয়াস করিম তার বয়সের বিবেচনায় অপূর্ণ জীবনের শেষদিকে এসে তার প্রয়াত পিতার মতোই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধিতা করে গেছেন। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে পাকিস্তানি মতাদর্শের ভিত্তিমূলে আঘাত করার কারণে পিয়াসের পিতা এম করিমদের শত্রু হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, সেই পাকিস্তানি আদর্শকেই বুকে ধারণ করেছেন পিয়াস করিম।

এখন পাকিস্তানি মতাদর্শকে লালন করা পিয়াস করিমের শেষ শ্রদ্ধার জায়গা কিভাবে হতে পারে শহীদ মিনার?

পিয়াস করিম যে শুধু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চেতনার জয়গানই গেয়ে গেছেন, এমন নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির এ রাষ্ট্রকাঠামোর বিরুদ্ধে যে আধাঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে, সেটাকে তার প্রতিটি শব্দ এবং বাক্যে সমর্থন জানিয়েছেন। তারা যখন এমনকি শহীদ মিনারও পুড়িয়ে দিয়েছে সেটাকেও সমর্থন করে গেছেন।

একাত্তরে কামানের গোলা দিয়ে শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়া, হত্যা-গণহত্যা-ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ আর ওই অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নাশকতা এবং টেলিভিশনের পর্দায় বক্তৃতা একই চেতনা থেকে উৎসারিত।

এখন সেই অপচেতনার মানুষকে কেনো শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে হবে?

তবে পিয়াস করিমের মরদেহ ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুলে ফুলে ঢেকে দেওয়ার আয়োজনের বিরোধিতাকে কোনো কোনো সুশীল পরমতসহিষ্ণুতার অভাব বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এটা কি পরমতসহিষ্ণুতার অভাব? নাকি চেতনাগত অবস্থান? পরমত ছিলো সেটা যেটা তিনি দিনের পর দিন টেলিভিশনে বলে গেছেন। সেখানে বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু তার কণ্ঠ কি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে? না। তাই তার মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতাকে যারা পরমতসহিষ্ণুতার অভাব বলার চেষ্টা করছেন, হয় তারা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অথবা এটা তাদের ইচ্ছা করে এক শয়তানি।

আসলে পিয়াস করিমের মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণার মধ্যেই একটা শয়তানি আছে। যেটা তিনি শুরু করেছিলেন শাহবাগে গণজাগরণের পর। এবং তখনই প্রমাণ হয় যে, তিনি তার প্রয়াত পিতার শুধু রক্তেরই না; চেতনারও উত্তরাধিকার।

সেই চেতনা হচ্ছে শহীদ মিনারের বিরুদ্ধে, সেই চেতনা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। তা হলে তাকে কেনো শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা?

সেটা আসলে এজন্য যে গণজাগরণের পর মিথ্যা প্রচারে যেভাবে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে, হেফাজতকে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার পথ করে দেওয়া হয়েছে; এখন একইভাবে তাকে শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। তাকে শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা যে বাধা দেখবে, এটা জেনেই এর উদ্যোক্তারা এরকম একটা ঘোষণা দিয়েছেন।

খেয়াল করলে দেখবেন, কারো মৃত্যুর পর বাঙালি মধ্যবিত্তের মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে তেমন একটা কথা না বলার যে মানসিকতা; সেটা কিন্তু প্রথমদিকে বজায়ই ছিলো। কিন্তু প্রতিবাদ শুরু হলো তখন যখন ঘোষণা আসলো যে পিয়াস করিমকে শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। ঘোষণার উদ্দেশ্যটাই ছিলো গোলমাল পাকানো।

এবং সেই উত্তেজনাটা তারা এরইমধ্যে সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এর মধ্যে সরকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জড়ানোর একটা চেষ্টাও হচ্ছে। সরকারকে জড়ানোর চেষ্টার কারণ, সরকারের জন্য বিব্রতকর এবং বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এর মধ্যে টেনে আনার কারণ যে, এ বিশ্ববিদ্যালয় সেই চেতনার উত্তরাধিকার যে চেতনার পথ ধরে শহীদ মিনার আর যে চেতনার বিরোধী পিয়াস করিম।

আরো একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। অন্য কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা সৃজনশীল কোনো কিছুর প্রমাণ না রেখে, শুধুই টক-শো করে আলোচিত পিয়াস করিমকে টক-শো করা অন্যদের কেউ কেউ এখন এমন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে, যেনো তার নাম বলতে হবে পিয়াসটটল কিংবা পিয়াসটিস। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই তারা বিষয়টাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সবকিছুর মূলে কিন্তু গর্ত থেকে জামায়াতকে বের করে আনার ফন্দিফিকির, যেটা জীবনের শেষ পাঁচ বছর ভালোভাবেই করে গেছেন পিয়াস করিম।

(শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং পিয়াস করিমের পিতা এম এ করিম সম্পর্কিত তথ্যের জন্য Dalton Souvato Heera’র কাছে কৃতজ্ঞতা। )

জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।