মালালা ইউসুফজাই ১৭ বছর বয়সী কিশোরী। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াট জেলার ছোট শহর মিঙ্গোরার বাসিন্দা।
শান্তিতে নোবেল প্রাপ্তির পর মালালা কেন্দ্রিক বিতর্কটি আবার বিশ্বের সামনে চলে আসে। সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে তাঁর নোবেল প্রাপ্তির সংবাদটি গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে। বিষয়টি সত্যি এমন যে, মালালার কারণেই কৈলাস সত্যার্থীর নোবেল অর্জনের আলোচনাটা অনেকটাই হারিয়ে গেল। এমনকি ভারতের মিডিয়াতেও কৈলাস সত্যার্থী তেমন গুরুত্ব পাননি, যতটা পেয়েছেন নোবেল বিজয়ী ১৭ বছর বয়সী ওই কিশোরী।
সারা বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও মালালার নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে ঝড় ওঠে। বাংলাদেশও এই ঝড়ে আক্রান্ত হয়। দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, মালালার নোবেল প্রাপ্তির বিতর্কে। বিশেষ করে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী এবং মনস্তত্ত্বের একটি পোস্ট মর্টেম হয়ে গেল।
মালালার নোবেল প্রাপ্তি বিতর্কে সমাজের সব স্তরের মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। রাজনৈতিক আদর্শের খোলস ছেড়েও পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। দল মত নির্বিশেষে বেশিরভাগই বিপক্ষে। দেশের উদারপন্থি, উগ্রপন্থি, জাতীয়তাবাদী, সাম্যবাদী সবাই মালালার সমালোচনায় মুখর।
বেশিরভাগ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতেই দলীয় আদর্শ সাপেক্ষে বিভাজিত হলেও মালালার নোবেল প্রাপ্তির ইস্যুটিতে বড় পরিসরে একটি সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। দল মত নির্বিশেষে ঢালাওভাবে অভিযোগ করছি, মালালার নোবেল বিজয়ের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পেছনে রয়েছে পশ্চিমা দুনিয়ার স্বার্থ। আমরা বিভিন্ন সংশয়ও প্রকাশ করছি।
পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতি অভিযোগটির পেছনে আমরা আবার ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যাও দিচ্ছি। অনেকেই বলছি, মালালাকে দিয়ে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। মালালার সাথে দীর্ঘদিন বাম ও বর্তমানে মার্কিনপন্থি তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবঙ্গের কৈলাস সত্যার্থীকে নোবেল দেওয়ায় অনেকেই আবার এই অঞ্চলে পশ্চিমাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছি।
আবার সংশয়বাদীদের বড় একটি অংশের মতে, মালালাকে ব্যবহার করে পশ্চিমারা পাকিস্তানের কৃষ্টি ঐতিহ্য ধ্বংস করতে চায়। একইসাথে, ইসলাম বিরোধী ক্যাম্পেইনে মালালাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনাও পশ্চিমা দুনিয়ার রয়েছে বলে জোর সন্দেহ করছি।
পুরুষ সমাজের সমান্তরালে এসে আমাদের নারী সমাজের বড় একটি অংশ মালালার সমালোচনায় মুখর। মালালার এই ঈর্ষণীয় সাফল্যে উজ্জ্ববিত না হয়ে তাঁর সাহস নিয়ে তামাসায় লিপ্ত হতে দেখা গেছে। ফেসবুকে নারী সমাজের অনেকেই মালালাকে হেয় করে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। ‘আপনারা প্লিজ আমাকে একটা গুলি করেন, তবে সাবধান জীবনটা যেন থাকে। তা না হলে নোবেল প্রাইজ মিস’ জাতীয় ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য লিখে নিজেদের ওয়ালে পোস্ট দিয়েছেন।
অনেকেই শান্তিতে নোবেল পাওয়ার যোগ্য এবং প্রত্যাশীদের একটি দীর্ঘ ফর্দ দিয়েছেন। ‘ম্যাডস গিলবার্ট, ম্যানিং, স্নোডেন এইরকম আরো বহুত কুতুব আছে যারা মাসে একটা কইরা নোবেল পাওয়ার উপযুক্ত” বলে মতামত জানিয়েছেন।
মালালা নাটকটি মার্কিনি গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ নির্মিত বলে একটি গল্প বাজারে রপ্তানি করছে আরেকটি বড় অংশ। তাদের যুক্তি, একে-৪৭ রাইফেল দিয়ে গুলি করলে বাঁচার কথা নয়। কারণ একে-৪৭ রাইফেলের গুলির ক্যালিবার ৫.৫৬। মাথার কাছ থেকে গুলি করলে প্রেসারেই চোখ গলে যাওয়ার কথা। বাঁচে কি করে? সে কি কৈ মাছ?
বাজারে অন্য আরেকটি গল্পও আছে। গল্পটি হল, মালালা পশতুন নয়, ককেশীয়। সে পাকিস্তানি নয়, পোলিস খিস্ট্রান মা বাবার সন্তান। জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই মালালার জন্মদাতা পিতা নন। এক্ষেত্রে ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর ডন পত্রিকার একটি রিপোর্টের বরাত ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তানের মাটিতে লাদেনকে হত্যার পর যখন পাকিস্তানের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, তখনেই আইএসআইয়ের তত্বাবধানে এই রিপোর্টি নির্মাণ করা হয়। এটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে খোদ পাকিস্তানের ভিতরেরই প্রশ্ন উঠেছিল।
পাকিস্তানেও মালালার নোবেল প্রাপ্তিতে সর্বসাধারণের মধ্যে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে ধর্মীয় উগ্রবাদীরাসহ অনেক সাধারণ পাকিস্তানিও খুশি হতে পারিনি। তেহরিক-ই-তালেবান, পাকিস্তান এবং জামাত-উল-আহরার মত জঙ্গি সংগঠনগুলো মালালাকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করেছে। বলেছে, মালালা হল পশ্চিমা অবিশ্বাসীদের দালাল, ইসলাম বিরোধী। তাছাড়া মালালা হয়ত জানে না যে আলফ্রেড নোবেল নিজেই বিস্ফোরকের আবিষ্কারক এবং তাঁর নামে এই শান্তি পুরস্কার। কথিত এই সাধারণ মানুষদের ব্যাখ্যাটিও একই। তারাও মনে করে, মালালা ইসলাম বিরোধী অবিশ্বাসী শক্তির হাতিয়ার।
বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে, উভয় দেশেই মালালার নোবেল প্রাপ্তির সমালোচকদের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। এই ক্ষেত্রে বড় দুইটি অভিযোগ দুই দেশের নাগরিক সমাজের বড় একটি অংশ করে আসছে। প্রথমটি হল এই অঞ্চলে পশ্চিমাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ সম্প্রসারণ এবং দ্বিতীয়টি হল ইসলাম বিরোধী হাতিয়ার। তবে কোন অভিযোগটি অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ, তা নিরূপণ করা হয়ত সম্ভব নয়। তবে এটি অনুমানযোগ্য, পশ্চিমা পুঁজিবাদিদের আঞ্চলিক ভু-রাজনৈতিক স্বার্থ সম্প্রসারণের অভিযোগটির চেয়ে মালালা যে ইসলাম বিরোধী হাতিয়ার, সেটি প্রাধান্য পেয়েছে।
মালালার এই অর্জনে সারা পাকিস্তানে খুশির বন্যা বয়ে গেছে। পাকিস্তানি হিসেবে অনেকেই গর্ব অনুভব করছে। পেশোয়ারে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষ আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছেন। উৎসব মুখর পরিবেশে সাধারণ মানুষ আনন্দ উল্লাস করছে। বিবৃতিতে নওয়াজ শরীফও বলেছেন, “আসলেই ওর জন্য পাকিস্তান গর্বিত। তাঁর কাজের কোন তুলনা হয়না। দেশের ছেলে মেয়েরা তাকে অনুসরণ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এই স্বপ্নই দেখছি’।
সোয়াটের পাখতুনেরা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। সারা বিশ্ব যেখানে তাদের সন্ত্রাসীদের গোষ্ঠী বলত, মালালা দেখিয়ে দিয়েছে সুযোগ পেলে তারা কি করতে পারে। অনেক পাখতুন মনে করে, মালালা সারা বিশ্বের কাছে সোয়াট জেলা থেকে একটি বার্তা পাঠিয়েছে মাত্র।
মালালার নিজের শহর মিঙ্গোরার সরুজ একাডেমির প্রিন্সিপ্যাল আহমেদ শাহ বলেন, আমরা মালালার জন্য গর্বিত। আমরা এজন্য সোয়াটের জনগণকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি আরও বলেন, মালালার নোবেল প্রাপ্তি ধর্মীয় উগ্রবাদিদের জন্য চপেটাঘাত, যারা নারী শিক্ষার বিরোধিতা করেছিল।
মিঙ্গোরার কুশাল সরকারি স্কুলের প্রধান ফারুক বললেন, সোয়াটের সব স্কুলের ছাত্র, বিশেষ করে মেয়েরা মালালাকে অনুসরণ করে। তারাও উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন দেখে এবং উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ গড়ার কাজে ভুমিকা রাখতে চায়।
সোয়াটের রোটারি ক্লাবের সভাপতি ফজল মওলা জাহিদ মনে করিয়ে দিলেন, নোবেল পাওয়ার পর মালালার দায়-দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা খুবই প্রয়োজন। তিনি পেশোয়ারের সচেতন সমাজের পক্ষ থেকে সোয়াটে একটি আন্তর্জাতিক নারী বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করার জন্য মালালার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
পাকিস্তানের আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির সেক্রেটারি মিয়ান ইফতেকার হুসেন বলেন, পাঞ্জাব প্রদেশের সরকার মালালার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার ঘোষণা দিয়েছে। একই সাথে খাইবার পাখতুনখোয়ার সরকারকে পাঞ্জাবের পথ অনুসরণ করার জন্য অনুরোধ করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, খাইবার পাখতুনখোয়াতে জামায়েত-ইসলামের সহযোগিতায় ক্ষমতায় রয়েছে ইমরান খানের পাকিস্তান-তেহরিক-ইনসাফ। এই দলটি প্রদেশটিতে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের সুবিধা নিয়ে রাজনীতি করছে, তা দেশে বিদেশে সকলেই জানে।
মালালাকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ঘোষণার সময় নোবেল কমিটির প্রধান নরওয়ের প্রাক্তণ প্রধানমন্ত্রী থরবিয়র্ন ইয়াগল্যান্ড মালালাকে নোবেল দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন “মালালার সাহস কে কুর্নিশ জানাতেই নোবেল’। তিনি আরও স্মরণ করিয়ে দিলেন “প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই ও সব করেছে”।
যারা আজকে মালালার নোবেল প্রাপ্তির সমালোচনা করে এত এত বাক্য ব্যয় করছেন, তাদের অনেকেই নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে মালালার অবদানের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন নাই। কোন প্রেক্ষাপটে নয় বছর বয়স থেকে একজন কিশোরী শিক্ষা অধিকারের জন্য একদল ধর্মান্ধের বিরুদ্ধে অহর্নিশি সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিলেন তা বুঝতে আমাদের অনেকেই ব্যর্থ হয়েছি।
আজ যারা রাইফেলের গুলি খেয়ে মালালা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন বলে কটাক্ষ করছেন, তাদেরকে একটি কথাই মনে করিয়ে দিতে চাই। প্রতিদিনই দেখছি আইএসের হাত থেকে বাঁচার জন্য লাখ লাখ মানুষ ইরাক এবং সিরিয়া থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেকেই বাধ্য হচ্ছে ধর্মান্তরিত হতে। অনেকেই আবার আইএস যোদ্ধাদের যৌনদাসি হতে বাধ্য হচ্ছে। এদের সবাই এক বয়সের নয়, ভিন্ন ভিন্ন বয়সের। কেউ তো মালালার মত গর্জে ওঠেনি।
গর্জে ওঠার হিম্মত ফেবুতে পোস্ট দিলেই আসে না। চরিত্রে থাকতে হয়, ব্যক্তিত্বে লালন করতে হয়। ব্যক্তি স্বার্থের উপরে ওঠে আসার মত মানসিক ক্ষমতাও থাকা দরকার। মনে রাখতে হবে, মালালা উগ্রবাদী ধর্মীয় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে নারী শিক্ষার জন্য সংগ্রামটি চালিয়েছে ২০০৯ সাল থেকে গুলি খাওয়ার আগ পর্যন্ত। প্রতিনিয়ত জঙ্গিদের হুমকি তাঁকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
২০১২ সালে মালালার উপর হামলার ফলে সারাবিশ্ব পাকিস্তানের সমালোচনায় মুখর হয়েছিল। সরকার বাধ্য হয়ে জঙ্গিদের দখলে থাকা স্কুলগুলোসহ সোয়াটের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করতে। এখনো সোয়াটের ৪০ শতাংশ স্কুল কয়েক বছর ধরে জঙ্গিদের দখলে রয়েছে। মালালা যে স্কুলে পড়ত, সেটির একটি অংশও সেনাবাহিনীর দখলে রয়েছে। কেন্দ্রের সরকারের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্কুলগুলো চালু করা যাচ্ছে না। কারফিউ দিয়ে সোয়াটের বেশিরভাগ এলাকা পরিচালনা করতে হয়।
মালালাকে ইসলাম বিরোধী হাতিয়ার ট্যাগ লাগিয়ে ফেবুতে সমালোচনা করতে দেখছি অনেক তরুণীকে। আজ পর্যন্ত মালালার ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকা নেই, এই অবস্থার কোন ছবি দেখি নাই। নারীরা সেলিব্রেটি হওয়ার পর যে অভিজাত জীবন যাপন করে, মালালার ভেতর তেমন কিছুই নেই। অনেকেই হয়ত জানেন, মাদার তেরেসার জীবনের প্রথম ভাগের ব্যয়বহুল জীবন নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিল।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে অনেক দেশের রাষ্ট্র প্রধানের সামনে বক্তব্য দিতে গিয়ে মালাল প্রায়শই বলেছে, ইসলাম তাঁর ধর্ম এবং একজন পাকিস্তানি হিসাবে সে গর্বিত।
অথচ যে সব তরুণীদের ফেবুতে সমালোচনা করতে দেখেছি, তাদের অনেকের পোশাক পরিচ্ছদে উগ্র আধুনিকতার ছাপ। আমাদের ভণ্ডামির স্তর যে কত উঁচুতে, তা নিজেরাই বুঝতে শিখি নাই।
মালালা মেয়ে বলে অনেকের গাত্রদাহ হচ্ছে। অজানা বিশ্বাসের আচ্ছাদনে নারীকে সমপর্যায়ে চিন্তা করতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি বারবার। তালিবান জঙ্গিদের নির্দেশ অমান্য করে মালালার স্কুলে যাওয়াটা পছন্দ হয়নি অনেকের। এই অনেকের মধ্যে সমাজে আধুনিক মানুষ হিসাবে খেতাবধারী মুখোশ ধারীরাও আছেন। মহাকাশ স্টেশনে যদি নারীরা কাজ করতে পারে, মালালা নোবেল প্রাপ্তিতে দোষ কোথায়? তাছাড়া মালালার আগেও বহু নারী নোবেল পেয়েছেন।
আবার মালালার বয়স নিয়েও অনেকের এলারজি আছে। এত অল্প বয়সে নোবেল!! আমাদের কুসংস্কারাছ্বন্ন মানসিকতা এবং চিন্তার বৈকল্য আসলেই অবাক করার মত। সাত মাস ভ্রমণ করে তিন কোটি চল্লিশ মাইল দূরে মঙ্গলে প্রথমে মানব পাঠানোর প্রকল্পে যদি তের বছরের কিশোরী প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হতে পারে, নারী শিক্ষার অধিকার আদায়ের যুদ্ধে বিশাল অবদানের জন্য সতের বছর বয়সী মালালাকে নোবেল দিতে সমস্যায় কোথায়?
শান্তিতে নোবেল দেওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছার প্রতিফলনের অভিযোগটি অমূলক নয়। পশ্চিমাদের পছন্দ অপছন্দ একটি বড় ভূমিকা রাখে। তবে তৃতীয় বিশ্বের নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে থেকে এমন কাউকে পাওয়া যাবেনা, যারা পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষার প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এখানে দুইটি প্রশ্ন রাখতে চাই, আরব বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে পশ্চিমাদের স্বার্থ এবং পুঁজিবাদী আগ্রাসন সম্প্রসারণের জন্য কাউকে কি নোবেল দিতে হয়েছে? ২০০৩ সালে ইরানের আইনবিদ শিরিন এবাদিকে নোবেল দেওয়ার পর আমেরিকার প্রভাব কি ইরানে বেড়েছে? এবাদি দেশটির আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নাগরিক সমাজে এমন কিছু করতে পারেন নি, যাতে করে ইরানে আমেরিকার স্বার্থ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমাদের এই অঞ্চলে আগে শান্তিতে নোবেলজয়ী দুইজন ছিলেন, এখন চারজন হলেন (মাদার তেরেসা বাদে)। প্রশ্ন হল, অং সাং সূচি কি মায়ানমারে আমেরিকার স্বার্থের পক্ষে তেমন কোন শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পেরেছেন ? যদি সামরিক শাসকরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার কুফলটি নির্ধারণ করতে না পারতেন, আমেরিকার সাথে মায়ানমারের সম্পর্কটি তৈরি হতো কিনা, সন্দেহ আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমাদের আস্থাবান ও বিশ্বস্ত ড. ইউনুস নোবেল পাওয়াতে পশ্চিমা বিশ্বের কি এমন লাভ হল? বাংলাদেশে কি পশ্চিমাদের মতাদর্শের সরকারকে ক্ষমতায় আনা গেছে? বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় এভাবে কাউকে ব্র্যান্ডি করে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা ও সম্প্রসারণের সুযোগ নেই।
মালালা ইউসুফজাইয়ের সাথে আবার ড. ইউনূস এবং সূচির একটি মৌলিক পার্থক্য এখনি দৃশ্যমান। ড. ইউনুসকে আজ পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের বিপক্ষে কোন বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি। সূচিকে নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, নিপীড়নের সময় কথা বলতে দেখা যায়নি। মুখে কুলুপ দিয়েছিলেন। নিজ দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে তারা যেমন নীরব, ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলিতেও নীরব। গাজাতে ইসরাইলের হামলার বিষয়ে তাদের শীত নিদ্রা ভেঙ্গেছে, যখন দেখল বিষয়টা যুদ্ধ বিরতির দিকে যাচ্ছে। এর আগে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। মালালা এক্ষেত্রে তেমন নয়। নোবেল প্রাপ্তির কিছু দিন আগেই পশ্চিমা বিশ্বকে পাকিস্তানে ড্রোন নয়, পড়াশুনার উপকরণ পাঠাতে বলেছেন।
মালালা পাকিস্তানের নারী শিক্ষা বিরোধী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর জন্য কেবল অনুকরণীয় নয়, পথ পদর্শক হিসাবেও তাকে ধর্মান্ধদের মেনে নেওয়া উচিত। মালালার প্রতিটি বক্তব্যে বারবারই ফিরে আসে শান্তির কথা, শিক্ষার কথা এবং সাম্যের কথা, যা আমাদের বিজ্ঞান বিমুখ এই অঞ্চলে বেশি প্রয়োজন। এমনকি নিজের উপর হামলাকারীদেরকেও মালালা ক্ষমা করে দিতে চায়। সে আশাবাদী, এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী অন্ধকার ছেড়ে আলোর দিকে আসবে।
আমরা যারা মালালার অবদান সম্পর্কে না জেনে লম্ফঝম্ফ করছি, বাজে বাজে মন্তব্য করে ফেবুর নিউজ ফিড বোঝাই করছি, তাদের উচিত নিজের জ্ঞান এবং বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে মন্তব্য করা। আগে নিজকে প্রশ্ন করা উচিত, সমাজের জন্য আমাদের অবদান কতটুকু? মন্তব্য করার আগে মনের ভেতর থেকে অন্ধত্ব মুছে ফেলাটা জরুরি।
প্রাসঙ্গিক বিধায়, একটি ছোট গল্পের উদাহরণ দিতেই হচ্ছে। এক ঘোষাল রাজাকে প্রতিদিন দুধ সরবরাহ করত। বেশি লাভের আশায় ঘোষাল দুধে পানি মেশাত। অপকর্মটির জন্য ঘোষালের বেশ অনুশোচনা হল। সে একদিন পানি না মিশিয়ে রাজাকে দুধ দিল এবং সেই দুধ খেয়ে রাজা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কারণ খাঁটি দুধটি রাজার হজম হয়নি। রাজার নির্দেশে ঘোষালকে রাজ দরবারে ডাকা হল। ঘোষাল রাজদরবারে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন, প্রতিদিনেই তিনি রাজাকে ভেজাল দুধ দিতেন। একদিনই তিনি খাঁটি দুধ দিয়েছিলন যা খেয়ে রাজা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
পরিশেষে, নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে মালালার বিশেষ অবদানটি অনুধাবন করে, অজানা অন্ধত্বের কোঠর থেকে মুক্ত হয়ে চলুন সবাই আলোর দিশারি হই। চলুন একসাথে শ্লোগান তুলি ‘“মিঙ্গোরার আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো”।
ড. বিজন সরকার: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউথ কোরিয়া, bipoly3001@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৪