বাংলাদেশ সরকার গত ১৬ জুন বঙ্গোপসাগরের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য মার্কিন বহুজাতিক সংস্থা কনোকো-ফিলিপসের সাথে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদন করেছে। এই ধরনের জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে সূচিত হলো এক কালো অধ্যায়ের।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এমন কী বিষয় আছে ওই চুক্তিতে, যা মানুষ জানলে চুক্তি সম্পাদনকারীদের সমস্যা হবে?
দেশের মানুষ এখনও বিস্মৃত হননি মার্কিন বহুজাতিক সংস্থা অক্সিডেন্টাল-ইউনোকলের সাথে সম্পাদিত কালো চুক্তির কথা। এর একটির পরিণতিতে অক্সিডেন্টালের দায়িত্বহীনতা-অবহেলা-ত্রুটির কারণে ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মৌলভীবাজার গ্যাসফিল্ডের মাগুরছড়ায় ব্লো-আউট হয়। ৫০০ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী কোনো সরকারই বিগত ১৪ বছরে মাগুরছড়ার গ্যাসসম্পদ, পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল-ইউনোকল-শেভরনের কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি। অক্সিডেন্টাল-ইউনোকলের সাথে কালো চুক্তির পক্ষে যারা শোরগোল তুলেছিলেন, তারাই এই কনোকা-ফিলিপসের সাথে চুক্তি প্রণয়নে মূল ভূমিকা রেখেছেন।
জাতীয় স্বার্থবিরোধী এই চুক্তির মধ্য দিয়ে সমুদ্রের দুটি ব্লকের ওপর মার্কিন বহুজাতিক সংস্থার দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। শুধু তাই নয়, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের গ্যাসসম্পদের ওপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার দখলস্বত্ব প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হলো। শুরু হলো সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের নতুন এক অধ্যায়ের।
সরকার যে চুক্তিকে জনচক্ষুর আড়ালে রাখতে যারপরনাই সচেষ্ট, সেই চুক্তির কিছু বিশেষ অংশ ভীষণভাবে জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী। চুক্তির ১৫.৫.৪ ধারায় আছে, ‘বাংলাদেশ যদি সমুদ্রের ১৭৫ মাইল দূরের গ্যাসক্ষেত্র পর্যন্ত প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা (পাইপ লাইন) স্থাপন করে, তাহলেই কেবল বাংলাদেশের পক্ষে পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রফিট গ্যাস রাখার অধিকার পাবে, তবে তা কোনোমতেই মোট প্রাপ্ত গ্যাসের ২০ শতাংশের বেশি হবে না।
এখানে যে কথা প্রয়োজন তা হচ্ছে, কন্ট্রাক্টর পাইপ লাইন স্থাপন করবে এমন কোনো উল্লেখ ওই চুক্তিতে নেই। এতে যা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়, এই চুক্তিতে বাংলাদেশের জাতীয় ও গণস্বার্থ রক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত। তাছাড়া পাইপ লাইন তৈরি করতে বাংলাদেশের যে খরচ পড়বে, তা কনোকো-ফিলিপসের প্রাথমিক বিনিয়োগের চেয়ে তিন গুণ বেশি। এছাড়া সামুদ্রিক ঝড় মোকাবিলার জন্য গভীর সমুদ্রে কিছুদূর পর পর পাইপ লাইনে যে স্টিলের সাপোর্ট বসাতে হবে তার জন্যও পড়বে বিপুল অঙ্কের খরচ। যার থেকে অনেক কম খরচে স্থলপথে বার্মা থেকে গ্যাস আকারে বা বিদেশ থেকে তরলায়িত আকারে গ্যাস আমদানি করা সম্ভব। তাছাড়া বাপেক্স আবিষ্কৃত দেশের স্থলভাগের সম্ভাব্য বৃহত্তম ‘সুনেত্র’ থেকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য সংস্থা মাত্র ২৭৭ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। সরকার এ বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চুপ। অথচ সমুদ্রের গ্যাসক্ষেত্র বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়ার সব ব্যবস্থা দ্রুত করার জন্য সরকারের তৎপরতা নজরে পড়ার মতো।
১৫.৫.১, ১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫ ও ১৫.৬ ধারায় বর্ণিত শর্তসাপেক্ষে এবং ১৫.৫.২ ধারায় বর্ণিত হিসাব অনুসারে কন্ট্রাক্টর চুক্তিকৃত এলাকায় উৎপাদিত যে কোনো পরিমাণ বিপণনযোগ্য গ্যাস বাংলাদেশের অংশসহ এলএনজি বা তরলায়িত করে রপ্তানির অধিকার পাবে। আবার কনোকো-ফিলিপস বাংলাদেশকে গ্যাস কেনার আহ¡ান জানাবে, কিন্তু তা গ্যাস আকারে দেবে, তরলায়িত করে নয়।
১৬ ধারায় বলা হয়েছে, পাইপ লাইন নির্মাণের অধিকার কনোকো-ফিলিপসের থাকবে। শুধু প্রাকৃতিক গ্যাসই নয়, চুক্তিতে পেট্রোলিয়ামের বিষয়টিও আছে। তার মানে তারা ধরেই নিচ্ছে, নির্দিষ্ট ব্লকে তেল পাওয়ারও সম্ভাবনা আছে। এছাড়া বাংলাদেশকে তার ক্রয়কৃত গ্যাস কোম্পানির পক্ষ থেকে পৌঁছে দেওয়ার দায়দায়িত্বের বিষয়টিও চুক্তিতে নেই। পিএসসি ২০০৮-এর ১০.২৭ ধারাতে অদক্ষতার জন্য বিপর্যয়ের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের যে বিধান ছিল, তা সংশোধন করে কন্ট্রাক্টরকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনার দায় থেকেও এই বহুজাতিক সংস্থাকে ছাড় দেওয়া হলো।
বঙ্গোপসাগরে সীমানা চিহ্নিতকরণের প্রায় সাড়ে ৪০০ নটিক্যাল মাইলের প্রস্তাবনা জাতিসংঘে জমা দেওয়া হলেও বিষয়টি নিষ্পত্তির আগেই ভারত ও বার্মার দাবি আপাতত একভাবে মেনে নিয়ে বাংলাদেশের অংশ তুলে দেওয়া হলো মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির হাতে।
এতে প্রতীয়মান হয় যে, এই চুক্তি সার্বিকভাবে জাতীয় স্বার্থ ও গণস্বার্থ বিরোধী এবং সর্বোপরি কনোকো-ফিলিপসের স্বার্থ রক্ষাকারী এক দাসত্ব চুক্তি। এই চুক্তি বাংলাদেশের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে বলে অনেকে ধারণা করছেন। মার্কিন আধিপত্যবাদের পুতুল হয়ে বাংলাদেশকে তার তাঁবেদারি করতে হবে।
এই অবস্থা চলতে পারে না। এই ধরনের অসম জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি জনগণ মেনে নিতে পারে না। জনস্বার্থবিরোধী এই চুক্তি রুখে দিতে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি জাতীয় সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন আর তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে বাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক শক্তি গণ-আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এই আন্দোলনে একাত্ম হয়েছেন।
তীব্র গ্যাস সঙ্কট মোকাবিলার জন্য সমুদ্রের ব্লক ইজারা দেওয়া হচ্ছে বলে সরকার দাবি করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে যদি গ্যাসই না থাকে তাহলে এই চুক্তি কীভাবে গ্যাস বা জ্বালানি সমস্যার সমাধান করবে? সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, স্থলভাগে গ্যাসের মজুত আছে ৭.৩ টিসিএফ, সম্প্রতি আরও ৫ টিসিএফ বেশি সন্ধান পাওয়া গেছে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিনের ঘাটতি ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট, আর চাহিদা বাড়ছে ১০ শতাংশ হিসাবে। আমাদের জ্বালানি চাহিদার ৭০ শতাংশ পূরণ হয় গ্যাস থেকে, ২৫ শতাংশ আমদানি করা তেল থেকে এবং ৫ শতাংশ কয়লা ও জলবিদ্যুৎ থেকে। কয়লাকে যদি গ্যাসের পরিমাপে হিসাব করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের মোট জ্বালনি ৪৫-৫০ টিসিএফ গ্যাসের সমান হয়। অর্থনীতির বিকাশ শতকরা ৭ ভাগ ধরলে ঘাটতি ১০০ টিসিএফ। এই গ্যাসের জন্য, যা বর্তমান মজুতের প্রায় ১০ গুণ, আমাদের পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে বঙ্গোপসাগরের ওপর। আর এই গ্যাস যেহেতু আগামী ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার একমাত্র অবলম্বন, তাই যে কোনো ধরনের রপ্তানিমুখী চুক্তি এই মুহূর্তে দেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে দেশের মানুষ দিশেহারা, বিপর্যস্ত। মূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মহাজোট সরকার বেশ বিব্রত মনে হলেও শরিক দলগুলোর মতামতকে গুরুত্বই দেওয়া হয় না। ১৪ দলের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি কর্তৃক উত্থাপিত ১৬ দফা সুপারিশকে সরকার আমলেই নেয় নি। একটু নজর দিলেই দেখা যাবে দ্রব্যমূল্যের এই লাগামহীন উর্ধ্বগতির সাথে এসব জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির সরাসরি সম্পর্ক আছে। প্রথমত, এসব চুক্তির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির হাতে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলি তুলে দেওয়ার ফলে দেশের পেট্্েরাবাংলার কাছ থেকে যে দামে গ্যাস কেনা যেত (অর্থাৎ ৭ টাকা, যা বর্তমানে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে) তার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি দামে একই গ্যাস বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে হয়েছে। যেমন, বাপেক্সসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের গ্যাসের দাম প্রতি হাজার ঘনফুট ২৫ টাকা। সেই একই গ্যাস যখন বিদেশী কোম্পানি উত্তোলন করে বিক্রি করছে, তখন পেট্্েরাবাংলা তা ভর্তুকি দিয়ে কিনছে প্রতি ঘনফুট সাড়ে তিন ডলার বা ২১০ থেকে ২৫০ টাকায়। উপরন্তু এসব বহুজাতিক কোম্পানির কর্পোরেট ট্যাক্সও পেট্্েরাবাংলা পরিশোধ করে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু বিদেশী মুদ্রায় এই গ্যাস কিনতে হয় তাই চাপ পড়ে রিজার্ভেও। তার মানে কী দাঁড়ায়? পুঁজির অভাবের কথা বলে বিদেশি বিনিয়োগের নামে বহুজাতিক কোম্পানি ডেকে এনে তাদের হাতে দেশ থেকে দ্বিগুণ পুঁজি পাচার করা হচ্ছে। ফলে আমাদের ক্র্রমাগত রাজস¡ ঘাটতি বাড়ছে, যার প্রতিফলন পড়ছে উৎপাদনশীল সব খাতের ওপর। গ্যাসের দাম বাড়ায় দাম বাড়ছে বিদ্যুতের। শিল্প-কারখানাসহ কৃষি সবকিছুতেই উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, বাড়ছে দারিদ্রতা।
সাধারণ মানুষ হয়তো বাজেট আর অর্থনীতির বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না ঠিকই, কিন্তু তাকে প্রতিদিনের বাজারের হিসাব কষতে হয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সাধারণ মানুষের। আর তাই অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই তেল-গ্যাস রক্ষার এই আন্দোলনে একীভূত হতে হবে মানুষকে।
এর আগে বিএনপি সরকারের আমলে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন ও পাচার, গ্যাস রপ্তানি এবং চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর মার্কিন কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দিয়েছিল এ দেশের মানুষ। ২০০৫ সালে ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি করে এশিয়া এনার্জির হাতে কয়লাখনি তুলে দেওয়া রুখে দিয়েছিল বামদলগুলির নেতৃত্বে দিনাজপুরে ঘটে যাওয়া জনগণের রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থান। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিরোধীদলের নেত্রী সে সময়ের দেশব্যাপী হরতালে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন। কালির বদলে তরিকুল, সালেহীন, আলামীনের রক্তে এশিয়া এনার্জির বহিষ্কারসহ ৬ দফা চুক্তি স¡াক্ষরিত হয়েছিল ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট। জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, ‘এই চুক্তি না মানার পরিণতি হবে ভয়াবহ’। ক্ষমতায় আসার ৩ বছরের মধ্যে তিনি আজ নিজের বক্তব্য থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এখন মহাজোট সরকার মার্কিনি তাঁবেদারি অটুট রাখতে মহাতৎপর। এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। বাঙালির এই ঘুরে দাঁড়ানোর যে ইঙ্গিত আমরা অনুভব করছি। সরকার কী তা অনুভব করেন?
সৈয়দ আমিরুজ্জামান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
E-mail : syed_a_zaman@yahoo.com
বাংলাদেশ সময় ২১৪১ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১১