ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ইন্দিরা গান্ধীকে সাফল্যের নিশ্চয়তা জেনারেল মানেক শ’র

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪১ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৭
ইন্দিরা গান্ধীকে সাফল্যের নিশ্চয়তা জেনারেল মানেক শ’র স্বাধীনতার রক্ত-কথন

মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে কূটনৈতিক সহায়তা দিয়েছিল। এ কূটনৈতিক সহায়তা করতে গিয়ে ভারত কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, বাংলাদেশ ইস্যুকে আন্তর্জাতিকীকরণ। কারণ, বিষয়টি বিশ্বের নজরে না আনলে বিশ্ববাসী বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবে না। সেই সাথে ভারতের কূটনৈতিক সহায়তার বিষয়টিও একটি ন্যায্যতা পাবে না।

ভারত চেয়েছে শরণার্থী সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসতে ও জাতিসংঘে তুলে ধরতে। কারণ, ভারত প্রায় ১ কোটি বাঙালিকে তার নিজ ভূখণ্ডে আশ্রয় দিয়েছে।

তাদের প্রতি মানবিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। তাই তারা চেয়েছে বিষয়টি সবার নজরে আসুক।

ভারত আরেকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে, তা হচ্ছে মানব ইতিহাসের ট্র্যাজেডিকে বৈশ্বিক সহানুভূতির অঙ্গীভূত করা, পাকিস্তানের গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধসমূহকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা। বিশ্ব জনমত তৈরি করতে তারা গুরুত্ব দিয়েছে। এই সমস্যা নিরসনে ভারত প্রাথমিকভাকে বিষয়টিকে রাজনৈতিক সমাধানের পথে এগিয়ে নিতে চেয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তারা বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করা ও সর্বশেষে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিশ্চিত করার ওপরই গুরুত্বারোপ করেছে।

কিন্তু ভারত মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দিলেও ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা সম্মুখ সমরে অংশ নেয়নি। পাকিস্তানের আক্রমণের প্রেক্ষিতেই তারা যুদ্ধে অংশ নেয়। ভারতের এই বিলম্বে সে দেশেও সমালোচনার ঢেউ ওঠে। জনগণ এ জন্য ইন্দিরা গান্ধী সরকার ও সে দেশের সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করে। এমনকি এ বিষয়ে ভারতের চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এসএইচএফজে মানেক শ’কে অভিযুক্ত করে এই বলে প্রচার করা হচ্ছিল যে ‘তার পা বরফে আটকে আছে’। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তার সিদ্ধান্তেই অটল ছিলেন। তার কাছে বিবেচ্য ছিল বিশ্ব জনমত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিষয়গুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া।

শ্রীমতি গান্ধী জেনারেল মানেক শ’র সঙ্গে বৈঠকে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন শ্রীমতি গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জেনারেল মানেক শ’র এই বিশ্বাস জন্মেছিলো যে, যুদ্ধের মতো একটি অতি গুরুত্বপর্ণ বিষয়কে হালকাভাবে বা আবেগ তাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। ইন্দিরা গান্ধী সেকারণেই ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করেছেন।

ইন্দিরা গান্ধী ও জেনারেল শ্যাম মানেক শ’র মধ্যে আরও বেশকিছু বিষয় নিয়ে কথোপকথন হয়। ইন্দিরা গান্ধী তাকে যুদ্ধ প্রস্তুতির কথা জিজ্ঞেস করেন। জেনারেল মানেক শ’ বলেন, “এ প্রসঙ্গে আমি কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার করে দিতে চাই। যুদ্ধে একজন মাত্র কমান্ডার থাকবে। বিএসএফ, সিআরপিএফ বা আপনি যাকে পছন্দ করেন-কারো অধীনে কাজ করতেই আমার কোনো আপত্তি নেই । ”

জেনারেল মানেক শ’ চাননি যে, কোনো সোভিয়েত এসে তার কর্তব্য নির্ধারণ করে দিক। তিনি চেয়েছেন তার একজন রাজনৈতিক অধিকর্তা থাকবে যার নির্দেশে তিনি কাজ করবেন। তিনি আরো বলেন, “আমি চাই না শরণার্থী, স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, সব মন্ত্রণালয় আমাকে নির্দেশ দিক। এবার আপনি মনস্থির করুন। ”

জেনারেল মানেক শ’র জবাবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “ঠিক আছে, শ্যাম। আপনিই অধিনায়ক এবং কেউ আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। ধন্যবাদ। ” এরপর জেনারেল মানেক শ’ বলেন, “এবার আমি আপনাকে সাফল্যের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। ”

মে মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং-এর জন্য নিজস্ব সেনাবাহিনী নিযুক্ত করা ছাড়াও ভারত সরকার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটি ট্রান্সমিটার বরাদ্দ করেও বাংলাদেশ সরকারকে সম্প্রচারের ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।

মে মাসের শুরুতে প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে লিখিতভাবে সামরিক পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেন। ওসমানী গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর একটি নিয়মিত বাহিনী গঠনের ওপর জোড় দেন। গেরিলা বাহিনীর সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ হাজার এবং নিয়মিত বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ২৫ হাজার নির্ধারণ করা হয়। এ অনুযায়ীই পরবর্তী কয়েকমাস যুদ্ধ পরিচালিত হয়। পরে অবশ্য গেরিলা যুদ্ধের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ সমরবিদ না হয়েও বিভিন্ন দেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সশস্ত্র কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। তিনি জানতেন, কনভেনশনাল রীতিতে শক্তিশালী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহজে পরাজিত করা সম্ভব হবে না। চীন-ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতার আলোকে একটি সুসংগঠিত গেরিলা বাহিনীই কেবলমাত্র আঘাতের ওপর আঘাত করে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে শত্রুদের পর্যুদস্ত করে বিজয়ে আনতে পারে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণমানুষের যুদ্ধ। তাই তারা স্বল্পসময়ের মধ্যে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারে, দীর্ঘ মেয়াদী প্রথাগত যুদ্ধে নয়। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দিনগুলোতে গেরিলা যুদ্ধের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৭
এমজেএফ

আরও পড়ুন...
** নিক্সনের কাছে ইয়াহিয়ার নালিশ
** টিক্কা বললেন, আমরা আগে গুলি চালাইনি
** ‘টাইগার নিয়াজী’ হয়ে গেলেন ‘বাংলার শৃগাল’
** ইয়াহিয়াকে নিকোলাইয়ের হুমকি, সমর্থন চৌ এনলাইয়ের
** ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ​
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন
** শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে
** স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।