‘গত কয়েক দিন ধরেই চলছে এমন অবস্থা। ব্যবসা-বাণিজ্য নেই বললেই চলে।
কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলার মধ্যে ইটনা, মিটামন, অষ্টগ্রাম পুরোটাই হাওর অধ্যুষিত। ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, নিকলি, করিমগঞ্জ ও তাড়াইল আংশিক হাওর। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রভৃতি জেলা প্রবলভাবে হাওর-নির্ভরশীল। ধান, চাল, মাছ, তরকারির জন্য জেলাগুলো তাকিয়ে থাকে হাওরের দিকে। হাওরাঞ্চলের অকাল বন্যার বিরূপ প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া হাওর-নির্ভরশীল জেলাগুলোতে ক্রমে ক্রমে ফুটে ওঠছে। কিশোরগঞ্জ শহরের তিনটি প্রধান বাজারেও সেই চিত্র স্পষ্ট।
‘সকালের কাচারি বাজার কয় দিন ধইর্যা আর জমে না। ’ রিক্সাচালক নূরু মিয়া বড়বাজারে যেতে যেতে জানালেন। কোর্ট-কাচারির পাশে চাকরিজীবীদের সুবিধার্থে ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত ‘কাচারি বাজার’-এর রমরমা কমে গেছে, এটাই বুঝালেন তিনি। বড়বাজারের মুখে দেখা গেলো হাহাকার অবস্থা। ‘রাইতের পুরান থানা বাজারও অহন ভাঙা-হাট’, ভাড়া নিতে নিতে বললেন নূরু মিয়া।
অন্য সময় দুপুরে গমগম-করা বড় বাজারে ঘুরছেন হাতে-গোণা কয়েকজন মানুষ। মাছের জন্য বিখ্যাত কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের বড়বাজারের মাছপট্টি খা খা করছে। ‘সাপ্লাই নাই, সব মাছ ভেসে গ্যাছে’। মাছ ব্যবসায়ী পরিমলের কণ্ঠে খেদ। সত্যিই, হ্যাচারিতে চাষ-করা সামান্য কিছু মাছ ছাড়া হাওর, নদী, বিল, বাওরের দেশীয় মাছ বলতে গেলে কিছুই নেই। পাঙ্গাস, কাতল, রুই, মৃগেল, তেলাপিয়া এসবই আছে সামান্য পরিমাণে। স্থানীয় প্রজাতির শিং, মাগুর, চিংড়ি, কৈ, পাবদা, বাইম, চিতল, আইড়, বোয়ালের দেখা নেই। অল্প যা আছে সেগুলোর দামও আকাশচুম্বি। অন্য সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
পাশেই ‘চাউল মহল’-এ থমথমে অবস্থা। অন্য সময় যেখানে ট্রাকের ট্রাক ধান-চাল ওঠা-নামা করত, সেখানে চাঞ্চল্য নেই। ‘বৃষ্টি আর হাওরের বন্যায় সরবরাহ একদম কমে গেছে’, রুমন ট্রেডার্সের ম্যানেজার আশিক মিয়া জানান। ‘বৈশাখের এই সময় হাওর থেকে প্রতিদিন ২০/৩০ ট্রাক ধান শহরের রাইস মিলগুলোতে আসতো। একেক ট্রাকে থাকত ২০০/২৫০ বস্তা। বন্যা-বৃষ্টিতে ধান নষ্ট হয়ে গেছে। কিছুই আসছে না। ’ আশিক মিয়া দুঃখের সঙ্গে বললেন, ‘এ বছর লোকাল লতা বোরো, টেপি বোরো চাল পাওয়া যাবে না। ’
সরবরাহের ঘাটতির প্রভাব চালের বাজারে লক্ষ্য গেল। গত কয় দিনে হু হু করে বেড়েছে চালের দাম। বিআর-৪৯ এক বস্তার দাম ১৮০০ টাকা থেকে ২২০০ টাকা হয়েছে। বিআর-২৮ হয়েছে ২০০০ থেকে ২৩০০। পাইজাম ২১০০ থেকে ২৪০০। নাজিরশাইল ২১০০ থেকে ২৪৫০। স্বর্ণা-৫-এর বস্তা প্রতি দাম ১৭০০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২১০০ টাকা। পাইকারি বাজারের প্রতিক্রিয়া পড়েছে খুচরা বাজারেও। কেজি প্রতি চালের দাম অল্প অল্প করে বাড়ছে প্রতিদিনই।
বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ব্যবসায়ীরা জানেন না। আগাম ব্যবস্থা নিয়ে খাদ্যাভাব বা সঙ্কট মোকাবেলার বিষয়ে কেউ কিছু জানাতে পারেন নি। স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকের কথায় বোঝা গেল, প্রশাসনের সবাই হাওরের দিকে মনোযোগী। সেখানে প্রতিদিনই ছোট-ছোট বাঁধ ভাঙছে। পানিতে তলাচ্ছে নতুন নতুন জায়গা। অকাল বন্যার সঙ্গে লাগাতার বৃষ্টি প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ ও দুর্যোগ দুই-ই বাড়াচ্ছে।
‘হাওরের বন্যার প্রভাব কিশোরগঞ্জে পড়তে শুরু করেছে। হাওর-বেষ্টিত জেলাগুলোর আর্থিক পরিস্থিতিতে চাপ বাড়ছে। ’ জেলা পাবলিক লাইব্রেরিতে আলাপকালে বলেন নাগরিক আন্দোলনের নেতা এডভোকেট নাসিরউদ্দিন ফারুকী। বাইরে তখনো ঝুমঝুম বৃষ্টি। ‘বন্যার পাশাপাশি এ রকম বৃষ্টি চলতে থাকলে হাওরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও আশেপাশের এলাকাতেও নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। গরিব মানুষের রোজগার কমবে। হাওর-অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত মানুষজন, ব্যবসায়ী, মজুর, ফরিয়ারা আক্রান্ত হবে। ’ আশঙ্কা প্রকাশ করলেন তিনি।
বৃষ্টির মধ্যে প্রায়-ফাঁকা আদালত চত্বর পেরিয়ে আইনজীবী সমিতি ভবনে গিয়েও দেখা গেল লোকজনের ভিড়হীন পরিস্থিতি। চেম্বারে আলাপকালে জেলা গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন পুরো বন্যা ও বৃষ্টিজনিত অবস্থা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘উপদ্রুত-প্রবণ হাওরের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রায়-প্রায়শই আবেগময় রাজনৈতিক কথাবার্তা হয়। কিন্তু কাজের কাজ বিশেষ কিছু হয় না। দেশের এক বিরাট অংশ জুড়ে অবস্থিত এই হাওরের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাবকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে টেকসই নীতি, পরিকল্পনা ও প্রকল্প গৃহীত না হওয়াটা সত্যিই দুঃখজনক। ’ তার মতে, ‘মানুষ ও অর্থনীতি বাঁচানোর স্বার্থে হাওরের দুর্যোগ এবং দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। ’
কথাগুলোর সঙ্গে সায় দিয়ে পাশে বসা নারীনেত্রী অ্যাডভোকেট মায়া ভৌমিক বলেন, ‘অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও হাওরের বন্যার জন্য ৫টি জেলার ৩০টি উপজেলার হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পড়াশোনার চরম ক্ষতি হচ্ছে। নারী-শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে সঙ্কটাপন্ন হওয়ার খবর পাচ্ছি আমরা। দরিদ্র পরিবারগুলোর অনেকগুলোই এই দুর্যোগের ধাক্কা সামলাতে না পেরে নিঃস্ব ও ভূমিহীনে পরিণত হবে। হাওরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও নানা রকম আর্থ-সামাজিক কুপ্রভাব বাড়বে। ’
এখনই মন্দা, মঙ্গা বা দুর্ভিক্ষের মতো চরম অবস্থার কথা যদিও কেউ বলছেন না, তথাপি পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে এবং যথাযথভাবে পূর্ব-প্রস্তুতি নিয়ে নানামুখী বিপদ আগেভাগে সামাল দেওয়া সম্ভব না হলে চরম সঙ্কট দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও কেউ উড়িয়ে দিচ্ছেন না। উপদ্রত অঞ্চলের ত্রাণ ও পূণর্বাসনের পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থা ও সরবরাহ চেইন বজায় রাখার প্রতিই গুরুত্ব দিয়েছেন সবাই। সকলেই অভিন্ন পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কোন অসাধু সিন্ডিকেট যেন খাদ্যাভাব বা হাহাকার তৈরি করতে না পারে, সেজন্য কঠোর পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে। ’
এলোমেলো ভাসমান মেঘের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া বৃষ্টিতে নিকষ-কালো হয়ে থাকা কিশোরগঞ্জের আকাশ তখনো বিষণ্ন মুখে থমকে আছে। মানুষ আর প্রকৃতি অপেক্ষমাণ সূর্যের আশাবাদী আলোর জন্য। উপদ্রুত পরিস্থিতি পেরিয়ে উজ্জ্বল দিনের খোঁজে সংগ্রামরত হাওরের জনমানুষের জলমগ্ন অবয়ব দোলা দিচ্ছে চেতনার চৌকাঠে। জানাচ্ছে, মানবিক সংগ্রামের সঙ্কল্প। যেন বা অস্ফূট কণ্ঠে বলছে, শেষ পর্যন্ত সংগ্রামী মানুষেরাই জয়ী হবে প্রকৃতি ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। এভাবেই অঙ্কিত হচ্ছে মানুষের সংগ্রাম-গাথা জনপদে জনপদে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৭
এমজেএফ