ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

‘তিনি যদি পণ্ডিত তবে মুর্খ কে?’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩১ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৭
‘তিনি যদি পণ্ডিত তবে মুর্খ কে?’ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর

সমাজ সংহতি, জাতীয় ঐক্য ও প্রগতির পথে বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও কর্তব্য সব সময়ই কাম্য। কিন্তু দেশের বুদ্ধিজীবী নামধারী শ্রেণিটির দিকে তাকালে তাঁদের নেতিবাচক চরিত্রের ছায়া দেখে প্রায়-প্রায়শই সাধারণ মানুষ বিরক্ত ও অস্থির হয়।

যিনি সাহিত্যিক, যিনি শিল্পী, এবং যিনি বুদ্ধিবৃত্তিকেই কাঁঠাল হিসাবে মাথায় রেখে নিজের ভরণ-পোষণে লিপ্ত, তিনি আজকাল মনে করছেন সমাজ ও মানুষের কল্যাণ ও উন্নতির জন্য, দেশের মঙ্গলের জন্য, ইতিবাচক কথা বলার জন্য মুখ খুলবার ‘সরলতা’ কখনই যেন তাঁর বা তাঁদের না হয়। ভাবখানা এমন যে, প্রতিটি বিষয়কেই ‘জটিল’ বা ‘গরল’ করে দেওয়ার কাজটিই যেন বুদ্ধিজীবিতার লক্ষ্যণ!

বুদ্ধিজীবী চারদিকে অধঃপতন চোখের সামনে দেখেও মুখ খুলবেন না, এর চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় আর কি হতে পারে! আর যদি তিনি কথা বলেন, তবে সেটা যখন রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বা ব্যক্তিগত লাভ হবে, তখনই বলেন! অন্য সময় কদাচ নয়।

‘বুদ্ধিজীবী’ নাম ধারণকারীদের এই যে সুবিধাবাদী, নির্লিপ্ত অবস্থা, তা শুধু অকাম্যই নয়, সমাজ ও মানুষের জন্যও চরম ক্ষতিকর বটে।

অথচ দেড়-দুই শ’ বছর আগেও, ঔপনিবেশিক আমলের ইংরেজ-অধীনস্থ বুদ্ধিজীবীরাও এহেন নির্লিপ্ততায় আক্রান্ত ছিলেন না। যারা সুবিধাবাদী ও নির্লিপ্ত ছিলেন, তারা সমালোচিত ও অপমানিত হয়েছেন। ‘বুদ্ধিজীবী নামধারী অথর্বদের’ কঠোরভাবে লাঞ্ছিত করার ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ - ২৯ জুলাই ১৮৯১) দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী তৎপরতা আজো মনে হয় প্রাসঙ্গিক।

বিদ্যাসাগর সাহিত্যিক ও অধ্যাপক হয়েও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের ‘চরিত্রহীন’ চারিত্র্যিক নস্টামীকে নিঃসংকোচে লাথি মেরে সমাজে ও দেশে সত্যভাষণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ‘তিনি যদি পণ্ডিত তবে মুর্খ কে?’ এই বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক প্রশ্ন উত্থাপন করে ঔপনিবেশিক আমলের নিরাসক্ত ও সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের দিকে প্রকাশ্যে আঙ্গুল নির্দেশ করেছিলেন তিনি। বিদ্যাসাগর জানতেন, জীবন-ধারণের জন্য যে বৃত্তিই মানুষ গ্রহণ করুন না কেন, দেশের নাগরিক হিসাবে তাঁর পক্ষে ইতিবাচক ও কল্যাণকামী সত্য কথা প্রকাশের অধিকার কেউ কখনই কেড়ে নিতে পারে না। দেশের অনৈক্য, চিন্তার বন্ধ্যাত্ব, সমাজের খণ্ডায়ন, অকল্যাণ, অধঃপতন ও ভ্রষ্টাচার দেখে চুপ থাকার মধ্যে বুদ্ধিজীবী বা কোনও দায়িত্বশীল মানুষের দায়িত্ব পালনের কাজ কীভাবে নিষ্পন্ন হতে পারে? এই প্রশ্ন সব সময় উত্থাপন করে বিদ্যাসাগর মানুষকে সামাজিক ও নৈতিক সমস্যার সমাধানে তৎপর হতে উৎসাহিত করেছিলেন। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন, সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে ‘ইতিবাচক ও ফলপ্রসু’ রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক ও নৈতিক ক্ষেত্রেও ‘ইতিবাচক ও ফলপ্রসু’ পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য।

বিধবা বিবাহ প্রচলনসহ অনেক ক্ষেত্রে মানুষ ও সমাজের মধ্যে ইতিবাচকতা এনে সাফল্য অর্জন করলেও জীবনের সর্বক্ষেত্রেই বিদ্যাসাগর সফল হয়েছিলেন, এমনটি বলা যায় না। কারণ আমাদের সমাজে ন্যায়বোধের পক্ষে সংগ্রাম করাটা প্রবলভাবে বিরোধিতায় আক্রান্ত। এই আক্রমণের ইতিহাস সুপ্রাচীন। খোদ বিদ্যাসাগর পর্যন্ত জীবনের শেষ লগ্নে মানুষ ও সমাজের উপর আস্থা হারিয়ে নৈরাশ্যবাদী হয়ে সমাজের এককোণে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মানুষ ও আত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় বিরক্ত ও মর্মাহত হয়ে তিনি তাঁর চিরকালীন সংগ্রামী ভূমিকা বর্জন করে চুপ মেরে ছিলেন।

গোলাম মুরশিদ ‘বিদ্যাসাগর’ নামক জীবনী গ্রন্থে জানাচ্ছেন (পৃ. ১৬৯) , ‘‘যুদ্ধ শেষে জয় অথবা পরাজয় একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয়। কিন্তু পরাজয় মেনে নেওয়া যথার্থ সংগ্রামীর লক্ষণ নয়। দীর্ঘকাল প্রগতিশীল একটি ভূমিকা বিপুল শৌর্যবীর্য নিয়ে পালন করার পর, আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে, অনুসারী ও সঙ্গী না পেয়ে, তিনি জীবন্মৃত অবস্থায় আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর এ পলায়নী ও মানুষের উপর আস্থাহীন দীন মনোভাব দেখে, তাঁর প্রতি করুণা বোধ করি। এমন কী, এ মানুষী দুর্বলতা দেখে, হিউম্যানিস্ট পণ্ডিকে কালের আদালতে ক্ষমা করাও বোধ হয় সম্ভব নয়। বিদ্যাসাগরের দৃষ্টি সমাজকে ছাড়িয়ে আর একটু প্রসারিত হয়ে দেশ এবং শাসন ও শোষণের দিকে অগ্রসর হলে তাঁকে অতুলনীয় প্রগতিশীল বলে আখ্যায়িত করা যেতো। দৃষ্টির সেই প্রশস্ততার অভাবে, তিনি শুধু মানবপ্রেমিক ও মানবতাবাদী হয়েই রইলেন। মানুষের মুক্তির সন্ধান দিতে পারলেন না। ”

এই সমালোচনার পরেও আমরা বলতে পারি যে, বিদ্যাসাগর মানবহিতৈষী রূপে যতটুকু কাজ করেছেন, ততটুকু কাজের কাজ করার মতো লোকও তো বুদ্ধিজীবী সমাজে তখন ছিল না। এখনও আমাদের চারপাশে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী রূপে মানুষ, সমাজ, প্রকৃতি ও পরিবেশ-বান্ধব বুদ্ধিজীবী খুব কমই পাওয়া যাচ্ছে। যারা আছেন, তাদের অধিকাংশই লেবাস বা ভেকধারী।

এখন প্রশ্ন হলো, সমাজে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না কেন? পণ্ডিত, বিদ্যাধারীর অভাব নেই, কিন্তু তাদের মধ্যে মানব-কল্যাণমুখী বুদ্ধিবৃত্তিক মনোভাব ও তৎপরতা কোথায়? ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগের উদাহরণই বা কোথায়? এসব কথা খোদ শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকেই গভীরভাবে ভাবতে হবে। এটাও মনে রাখা জরুরি যে, ব্যক্তিস্বার্থের চক্কর থেকে বের হতে না পারলে বাংলাদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা ইতিবাচক পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারবেন না; বিশ্বব্যাপী ধাবমান উন্নতি ও প্রগতির পথে মানুষকে প্রণোদিতও করতে পারবেন না। পদে পদে ব্যর্থই হবেন।

অথচ  সমাজ, মানুষ, রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষুদ্রতা ও অনৈক্যের বীজ যেভাবে বাড়ছে, যেভাবে লাভ, লোভ ও আত্মস্বার্থতা চারদিকে মাথাচাড়া দিচ্ছে; এতে ব্যক্তি বিশেষের লাভ হলেও সমষ্টির ক্ষতির আশঙ্কাই ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য হলো সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা এবং অধঃপতন ও ক্ষুদ্রতার বীজ উৎপাটনে তৎপর হওয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাই বিভেদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। উস্কানি ও বিভ্রান্তি বিস্তারের পাণ্ডা হয়ে কাজ করছেন। এতে মানুষ পথ পাওয়ার বদলে আরও বেপথু হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতির বদলে অবনতি হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের ভ্রান্তির কারণে।  

আমাদের অতীত কালের সম্মানীয় বুদ্ধিজীবীগণ আর যা-ই করুন, নিজস্ব ব্যক্তিগত স্বার্থের কর্মীতে রূপান্তরিত হন নি। বর্তমানে অনেকেই অতি সাধারণ স্বার্থবাদী মানুষের মতো হয়ে গেছেন। ক্ষুদ্র স্বার্থের পক্ষ নিতে গিয়ে বৃহত্তর জনতাকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করছেন। এই ধারা বন্ধ করা না গেলে অধঃপতন, অনৈক্য, ক্ষুদ্রতা ও খণ্ডতার অবসান ঘটবে না। পরিস্থিতি ক্রমে ক্রমে খারাপের দিকেই যাবে। বিভিন্ন ইস্যুতে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণই নানা বিভক্ত কাঠামোয় জনতাকেও আরও বিভক্ত করে ছাড়বেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজন বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি ও উদার মন এবং সঙ্কীর্ণতার অবসান। কাউকে না কাউকে বড় চিন্তা নিয়ে এগিয়ে আসতেই হবে। আগামীর দিকে তাকাতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ ও সমাজ সেজন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। অতএব, জনমানুষের চিন্তা, চেতনা, স্বপ্নের প্রকৃত জাগরণ ঘটাতেই হবে। এই ইতিবাচক জন-জাগরণের প্রণোদনা সৃজনে ব্যর্থদেরকে মানুষ আদৌ বুদ্ধিজীবী বলে স্বীকার করবে না, মানবেও না; তাদের সনদ-সার্টিফিকেট-বিদ্যার বহনের দিকে তাচ্ছিল্য ভরে তাকিয়ে অতীতের মতোই আবারও বলবে, ‘তিনি যদি পণ্ডিত তবে মুর্খ কে?’  

সমাজ-সংসার-চিন্তা-চেতনার অঙ্গনে নিজের সারথীকেই খুঁজবে মানুষ এবং সম্মিলিত পায়ে পায়ে হেঁটে যাবেই একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান ও কর্মমগ্ন অগ্রসর পৃথিবীর পথে প্রান্তরে। বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক তারুণ্য, আশাবাদী নারী ও পুরুষ আর পেছনে নয়, দেখতে ও চলতে চায় সামনের দিকে, পৃথিবীর অযুত সম্ভাবনার দিকে। এই মানব-গতিকে সামনের দিকে এগিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিজীবীর কাজ; রাজনীতিবিদ, মিডিয়া, সরকার, প্রশাসন, সকলের কাজ। মানুষের স্বপ্ন, সম্ভাবনা ও অগ্রসরতার কাজে সাহায্য না করে বাধা দিলে মানুষ কাউকেই ক্ষমা করবে না, এই নির্মম সত্যটি সবাইকে মনে রাখতে হবে।        

ড. মাহফুজ পারভেজ  ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও লেখক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনারত।
 


বাংলাদেশ সময়: ১৬২৪ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।