নানীর চোখ মুছতে মুছতেই মেয়েটা বন্ধ করে দিল নিজের চোখ। আর খুললই না।
রীতিকে কলকাতার হাসপাতালে রেখেই নীতির মরদেহ ভারত থেকে দেশে আনা হলো। সে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। নানী সানিডন প্রিপারেটরি স্কুলের অধ্যক্ষ সৈয়দা নাসরিন আক্তারকে রীতির পাশে হাসপাতালে রেখে তার মা শিক্ষক ও সংগীতশিল্পী শারমিনা চৌধুরী এবং বাবা ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন, নানা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বর্তমানে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. আবুল কাশেম, খালা ক্লোজআপ ওয়ান তারকা তাসমিনা চৌধুরী অরিন সহ দেশে ফিরে আসেন।
চট্টগ্রাম নগরীর হযরত মিছকীন শাহ (রহ.) মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে নীতিকে শেষবারের মতো ঘুম পাড়িয়ে আবার কলকাতা ফিরতে হচ্ছে তাদের। রীতিকে শোনানো হয়নি তার যমজ বোন নীতি আর নেই। বারবার রীতি প্রশ্ন করে যাচ্ছে, নীতি ভালো আছে তো, তার রক্তের প্লাটিলেট বাড়ছে? আরও হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত হচ্ছে সে। কারণ রীতি আর নীতির শরীর আলাদা হলেও আত্মা যে অভিন্ন!
চলতি বছরের ২০ মার্চ হঠাৎ নীতির জ্বর হয়। জ্বর কোনোভাবেই কমে না। চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নীতিকে নিয়ে যাওয়া হয়। কেউ বলে টাইফয়েড, কেউ বলে বাতজ্বর। এভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে দুই মাস চলে যায়। কেউ সঠিকভাবে বলতে পারেনি, আসলে কী রোগ হয়েছে। এরপর ঢাকায় একদিন ছোটাছুটি হলো। এরই মধ্যে নীতির যমজ বোন রীতিরও একই উপসর্গ দেখা গেল। শেষে সিদ্ধান্ত হলো, তাদের চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে। ততক্ষণে অনেক সময় চলে গেছে। দু’জনের শরীর জ্বরে ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে না খেতে পেরে শেষ হয়ে গেছে।
শেষমেষ তাদের ভারতের কলকাতায় আমরি হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। সেখানে রোগ নির্ণয় করে জানানো হয়, Crohn's Disease রোগ হয়েছে। এটি আলসারের মতো। রোগীর খাদ্যনালী থেকে পায়ুপথ পর্যন্ত ঘা হয়ে যায়। এই রোগ বোনম্যারোতে প্রভাবিত হয়। মানবদেহের রক্তকণিকা বোনম্যারোর লোহিত ও শ্বেত রক্তকণিকা উৎপাদনে বাধাগ্রস্ত হয়। রক্তের প্লাটিলেট কমতে থাকে। এছাড়া নিউট্রোফিল উৎপাদক শূন্যে নেমে আসে। প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগ বিভিন্ন ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এটার শেষ চিকিৎসা হচ্ছে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট।
বাংলাদেশে প্রাথমিক অবস্থায় রোগটি নির্ণয় করতে পারেনি কেউ। এটাই প্রমাণ করে, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার দৈন্যদশা। হয়তো প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করতে পারলে নীতি বেঁচে যেত।
নীতি মনি! হাসপাতালে, বিমানবন্দরে কিংবা যেখানে তোমাকে দেখেছি, মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছি, ‘মা, ভালো হয়ে যাবে’। কিন্তু পৃথিবীর নিষ্ঠুর বিধি-বিধান, আমাদের বেহাল চিকিৎসা ব্যবস্থা কোনোটাই তোমাকে বাঁচতে দেয়নি। এখন তুমি স্বর্গে মুক্ত বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছো। মাঝে মাঝে তোমার শোকাহত মা-বাবা-স্বজনদের দেখে যাচ্ছো। কিন্তু তোমাকে তো কেউ দেখছে না। তোমার মা কাঁদতে গিয়ে কাঁদতে পারছে না। কারণ রীতি জেনে যাবে তুমি নেই। তুমি আর ফিরে আসবে না। তোমার মা-বাবা ও নানুকে বাথরুমে লুকিয়ে কাঁদতে হচ্ছে।
আজ নীতিকে হারিয়ে মা-বাবা, নানা-নানী, আত্মীয়স্বজন সবাই শোকাহত। তাদের সমবেদনা জানানোর মতো কোনো ভাষা নেই। এখন পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা, সুমেহরা চৌধুরী রীতি যেন সুস্থ হয়ে উঠে। রীতির মাঝে স্বজনরা নীতিকে খুঁজে পাবে।
লেখক
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ব্যক্তিগত সহকারী সচিব
বাংলাদেশ সময়: ২০০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৭
এইচএ/