স্পেন ও ফ্র্যান্সের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত কাতালোনিয়া অঞ্চলটি আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে একেবারেই আলাদা। জাতিতে তারা স্পেনিশ নয়।
অতীতে বহুবার কাতালোনিয়া স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করলেও সফল হয় নি। কখনো ফ্র্যান্স, কিংবা কখনো স্পেন, অঞ্চলটিকে দখল করে রেখেছে। কাতালোনিয়া যে একটি আলাদা জাতি, সে কথা প্রকাশ করতেও তারা দ্বিধা করে নি।
এসব তথ্য জানা যায়, জন পেইন রচিত ‘কাতালোনিয়া: পোর্ট্রেট অব অ্যা নেশন’ নামের গ্রন্থটি থেকে। গ্রন্থটি আমার গোচরে এসেছে অদ্ভুতভাবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহকর্মী, বাংলা বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. মহীবুল আজিজ পঁচিশ বছর আগে গবেষণা কাজে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করছিলেন। তখন জন পেইনের গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশ পায়। আগ্রহী হয়ে বইটি তিনি সংগ্রহ করেন। মাঝের বছরগুলোতে বইটির কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। সম্প্রতি আবার নতুন করে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার আন্দোলন তীব্র হলে তিনি বইটির প্রসঙ্গে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
জন পেইনের গবেষণার মূল বক্তব্যই হচ্ছে, কাতালোনিয়া সম্পূর্ণ একটি আলাদা জাতিসত্তার অঞ্চল। পার্শ্ববর্তী স্পেন বা ফ্র্যান্সের সঙ্গে এ অঞ্চলের সাযুজ্য নেই। এবং কাতালোনিয়ানরা ইউরোপের অন্যন্য সকল জাতির চেয়ে আলাদা একটি জাতিসত্তা। এরা স্পেনিশ নন, গথ ও কেল্টিক জাতির উত্তরাধিকার। ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, জীবনাচারের দিক থেকেও এ অঞ্চলটি এবং এখানকার মানুষগুলো ভিন্ন। স্থাপত্যরীতি ও খাদ্যাভাসেও স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে কাতালোনিয়ার।
ইউরোপের ভূগোলে কাতালোনিয়া একটি ‘শোকেস’-এর মতো ছোট্ট ও সাজানো অঞ্চল। আয়তন মাত্র ৩০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। অপরূপ এখানকার আবহাওয়া ও প্রকৃতি। একদিকে ভূমধ্যসাগরের তীরঘেঁষা প্রায় সাড়ে ৫০০ কিলোমিটারের সৈকত এবং আরেক দিকে দুর্গম পিরোনিজ পর্বত অঞ্চলটিতে বৈশিষ্ট্যময় করেছে।
শিল্প, বাণিজ্য, পর্যটন ও বিনোদনের বিশ্ববিশ্রুত অঞ্চলসমূহের অন্যতম এই কাতালোনিয়ার কথা পৃথিবীর অনেক মানুষ না জানলেও মূল শহর বার্সেলোনার নামটি কিন্তু প্রায়-সকলেই জানেন, বিশেষত ফুটবলের কারণে।
কাতালোনিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো নগরায়ন ও বাণিজ্যিক প্রভাব। স্পেন তো বটেই, ইউরোপের অন্যতম ধনী ও সমৃদ্ধ অঞ্চল এটি। মজার ব্যাপার হলো, ধর্মের দিক থেকে এখানে খ্রিস্ট ধর্মের প্রাধান্য থাকলেও পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ধর্ম না-মানা লোকের সংখ্যা এখানে অনেক বেশি। ঐতিহাসিকভাবে এখানে রয়েছে বড় একটি মুসলিম সম্প্রদায়। কারণ, ইসলামের প্রাথমিক যুগে স্পেন বিজয়ী মুসা কাতালোনিয়া দিয়ে পিরোনিজ পর্বত পাড়ি দিয়ে ফ্রান্সে অভিযান চালিয়েছিলেন। দামেস্কের তৎকালীন শাসন ঈর্ষান্বিত হয়ে মুসাকে থামিয়ে দেওয়ায় ইসলামের জয়যাত্রা সেখানেই থেমে যায়।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ মূলতঃ আরব ও আফ্রিকান বংশোদ্ভুত। বৌদ্ধ ধর্মও এখানে বেশ প্রভাবশালী।
বিগত কয়েক শত বছরের ইতিহাসে কাতালোনিয়া স্বাধীন থাকার জন্য বার বার আন্দোলন ও যুদ্ধ করেছে। কিন্তু নিজের ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে পাশের দুই বড় প্রতিবেশী স্পেন আর ফ্রান্সকে কাবু করতে পারে নি কখনো।
নানা সময় হয় ফ্রান্স, নয় স্পেনের অধীনেই থাকতে হয়েছে এই অঞ্চলটিকে। সাম্প্রতিক সময়ে স্পেনের একনায়ক জেনারেল ফ্রাঙ্কোর অপশাসন অবসানে কাতালোনিয়ায় তীব্র আন্দোলন হয়।
১৯৭৪ সালে ফ্রাঙ্কোর পতনের পর ১৯৭৫ সাল থেকে অঞ্চলটি ধীরে ধীরে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায় করে নেয় এবং এবং শেষ পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা লাভ করে।
সর্বসাম্প্রতিককালে ২০১৪ সাল থেকে কাতালোনিয়া স্বায়ত্তশাসনে সন্তুষ্ট না থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন নতুনভাবে আবার আরম্ভ করে এবং অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিকভাবে সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে থাকে।
জনগণ, জনপ্রতিনিধি, গণভোট, সংসদ ইত্যাদি সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থেকেই দেশটির স্বাধীনতার গণদাবির প্রতিধ্বনি উচ্চারিত হয়। কেন্দ্রিয় শাসক স্পেনিশরা অবশ্যই কাতালোনিয়ার দাবিকে গণতান্ত্রিক মনোভাবের মাধ্যমে গ্রহণ করে নি। গণদাবিকে সম্মানজনকভাবে দেখেও নি।
এদিকে ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর একটি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার পর কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয় স্পেন এবং অঞ্চলটিকে সম্পূর্ণভাবে নিজের অধীনে নিয়ে আসার চেষ্টাও করে মাদ্রিদের শাসকবর্গ।
কিন্তু স্বাধীনতার পথে শেষ সোপানে অবস্থানকারী কাতালোনিয়াকে থামানো আদৌ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ইতিহাস বলছে, স্পেন থেকে সকল দিক থেকেই আলাদা ও স্বতন্ত্র এ অঞ্চলটি স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনও সমাধান গ্রহণ করবে না। স্পেন যদি এক্ষেত্রে সামরিক বা অন্যবিধভাবে শক্তি প্রয়োগ করে, তাহলে কাতালোনিয়াকে ঘিরে ইউরোপ একটি নতুন রাজনৈতিক সংকটের আবর্তে নিপতিত হবে। সমৃদ্ধ ও বাণিজ্যিক কাতালোনিয়ার অস্থিতিশীলতা শুধু স্পেনকেই নয়, সমগ্র পশ্চিম ইউরোপকেও বিপণ্ন করতে পারে। ফলে ইউরোপিয় ইউনিয়ন এ ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকবে না। শেষ পর্যন্ত কাতালোনিয়াকে স্বাধীনতা দিয়ে শান্তিপূর্ণ
সমাধানের পথই হয়ত স্পেনকে বেছে নিতে হবে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৮
জেডএম/