ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

‘আমরা’ গিলছি, কিন্তু কী?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৮
‘আমরা’ গিলছি, কিন্তু কী? বাজারের মুখরোচক এসব খাবারই স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ভয় পাইয়ে দেয় বেশি (ফাইল ফটো)

খাদ্যই মানুষের প্রথম ও প্রধান চাহিদা। মানুষ যতোদিন বেঁচে থাকবে, ততোদিন খাদ্য তার লাগবেই। শুধু মানুষ কেন, বেঁচে থাকার জন্য সব জীবেরই খাদ্য চাই। মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে তাই খাদ্যই প্রথম। বেঁচে থাকার জন্য খাবারের চেয়ে মূল্যবান আর কী আছে? বেঁচে থাকলেই কেবল অন্য প্রয়োজনের কথা আসে।

কিন্তু খাদ্য আসলে কী? এক কথায় যা খাই, তা-ই খাদ্য। তাহলে আমরা যে বলি অখাদ্য, সেটা আবার কী? অখাদ্যও কি খাদ্য? আমার যা খাই, তার সবই কি খাদ্য, নাকি এর মধ্যে অখাদ্যও কিছু আছে?

আমাদের দেশে নিরাপদ খাদ্য আইন নামে একটি আইন আছে।

বোঝাই যায়, নিরাপদ খাদ্য নিয়ে আমাদের এক ধরনের সমস্যা আছে, বা আমরা যা খাই তার সবকিছুই নিরাপদ খাদ্য নয়। এর মাঝে অনিরাপদ খাদ্যও আছে। ফলে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য আইন করতে হয়েছে। প্রকৃতি থেকে আহরিত খাদ্যের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অসৎ কর্মে নিরাপদ খাদ্যও অনিরাপদ খাদ্যে পরিণত হয়। মানুষ খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে, কিন্তু আমরা অনিরাপদ খাবার খেয়ে ‘মরিবার পূর্বেই মরিয়া যাই’।  

নিরাপদ খাদ্য আইনেই খাদ্য ও অখাদ্য’র (নিরাপদ খাদ্য ও অনিরাপদ খাদ্য) সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সঙ্গত কারণেই সে সংজ্ঞা অতি দীর্ঘ। কারণ, খাদ্যকে কোনো সংজ্ঞার মধ্যে আবদ্ধ করা কঠিন। তবে সেখানে একটি কথা বলা আছে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ- ‘যাহা মানবদেহের জন্য উপকারী আহার্য হিসেবে জীবন ধারণ, পুষ্টি সাধন ও স্বাস্থ্য-রক্ষা করিতে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, উহাই খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত হইবে’। আবার এখানকার কয়েকটি শব্দযুগল খুবই গুরুত্বপূর্ণ- ‘উপকারী আহার্য’ ‘পুষ্টি সাধন’ ও ‘স্বাস্থ্য-রক্ষা’।  

আমরা প্রতিদিন যে খাবার খাই তার মধ্যে এই তিনটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য কতটুকু থাকে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। উপকারী ও পুষ্টিসাধনের কথা বাদই দিলাম, এসব খাবার কতটুকু স্বাস্থ্যকর তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? এছাড়া ভোক্তা অধিকারের কথা না হয় না-ই বললাম। এক নামের চাল আরেক নামে বিক্রি হচ্ছে। তেলে ভেজাল, মরিচের গুঁড়োয় ইটের গুঁড়ো, দইয়ে টিস্যু পেপার, ভেড়ার মাংস হয়ে যায় খাসির মাংস, মহিষ হয়ে যায় গরু-এই অভিযোগের তালিকার শেষ নেই! আর হোটেল-রেস্তোরাঁয় ভেজাল খাবারের সমাহার। কিন্তু তারপরও আমরা টিকে আছি। আমাদের যে কই মাছের প্রাণ!

দেশে ‘খাদ্য আদালত’ আছে, ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ আছে, ‘খাদ্য পরীক্ষাগার’ আছে, ‘খাদ্য বিশ্লেষক’ আছে, ‘খাদ্য পরিদর্শক’ ও ‘পরিষদ’ আছে, আছে ফৌজদারী কার্যবিধি এমনকি দণ্ডবিধিও। কিন্তু সবার ওপরে যা আছে তা হলো, ‘খাদ্য ব্যবসা’, ‘নকল খাদ্য’ ও ‘ভেজাল খাদ্য’- এসবই ওই আইনের শব্দযুগল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সবকিছুর ওপর খাদ্য ব্যবসায়ীদের নকল ও ভেজাল খাদ্যের ব্যবসাই বুঝি জয়ী হচ্ছে। রমজান মাস এলে বিষয়টি আরও দৃশ্যমান হয়।  

ইফতারিতে ভেজাল খাদ্য ব্যবসায়ীরা আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পেঁয়াজি, বেগুনি, চপ, ছোলা, জিলাপিসহ আরও কত মুখরোচক খাবার। কিন্তু এসব খাবার কতটুকু আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমরা খাই? আমরা সবাই জানি এসব খাবার পুরনো বা ব্যবহৃত তেলে ভাজা। আছে বাড়তি রঙ মেশানো।

কিন্তু খাবার যা-ই হোক, সবকিছুতেই ‘অসাধারণ’ পরিবেশন। আমরা সব কিছু জানি, বুঝি। কিন্তু তারপরও এসব খাবার কিনি ও খাই। স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে ও অন্যের বিনা প্ররোচনায় আমরা ধীরে ধীরে আত্মঘাতী পথ বেছে নিই। আমাদের খাদ্য আদালত আছে, আইন আছে, ফৌজদারী কার্যবিধি আছে, দণ্ডবিধি আছে। তার পরও ভেজাল ও নকল খাদ্য ব্যবসা সবসময়ই চলতে থাকে। রমজান মাসে আরও বেশি চলে। সামনে যে ঈদ!

কিন্তু প্রশাসন একেবারে বসেও থাকে না। ইফতারির আগে-আগে অভিযানে বের হয়। ইফতারির পরও বের হয়। বিভিন্ন দোকান, হোটেল, সুপারশপে অভিযান চালায়। কয়েক ঘণ্টায় কয়েক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। গণমাধ্যমে সে খবর নিয়ে আমরা জনতা একটু কথাবার্তা বলি। তারপর আবার যা তা-ই। মাঝখানে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কিছু অর্থকড়ি জমা হয়, কিন্তু আমজনতার পোড়া তেলের মতোই ‘পোড়া কপাল’। এতো পোড়ে তা-ও শেষ হয় না।

কিন্তু সব দোষ কি কেবল ব্যবসায়ীদের? আমাদের সচেতনতা কোথায়? ভোক্তা অধিকার আইনের অধীনে আমরা কয়জন অভিযোগ করেছি? আদালত পর্যন্ত না-ই গেলাম। সেই সঙ্গে জেনে শুনে পচা-বাসি খাবার কি না খেলেই নয়? নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্যের কথা একবার ভাবুন। আর যারা এসব ভেজালের সঙ্গে জড়িত তারাও একটু ভাবুন। কারণ, সবাই ভোক্তা। ভুক্তভোগীও সবাই। এভাবে ভেজাল ও পচা-বাসি খাওয়ানো ও তার বাণিজ্য গুরুতর নৈতিকতার খেলাপ, অমানবিক ও দণ্ডনীয় তো বটেই।

নিরাপদ খাদ্য আইন করা হয়েছে আমাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য। খাদ্য উৎপাদনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনেই তা নিশ্চিত করা যায়। সেজন্য খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয়-সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের সঙ্গে যারা জড়িত তারা যেনে আইন মেনে সব কাজ করেন তা নিশ্চিত করাই ছিল এ আইনের লক্ষ্য। এ আইনের অধীনে সরকার ২৯ সদস্য বিশিষ্ট ‘জাতীয় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা পরিষদ’ নামে একটি পরিষদ গঠন করে, ৫ সদস্য-বিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ ও ২৮ সদস্য বিশিষ্ট ‘কেন্দ্রীয় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটি’ও গঠন করেছে। এর অধীনে আবার বিভিন্ন উপ-কমিটিও আছে। এসব কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা ও এখতিয়ার নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য তাদের অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সময়ে সময়ে আমরা সে ক্ষমতার প্রয়োগও দেখি। বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ আইনের অধীনে অনেক অভিযোগের বিচার আবার ভ্রাম্যমাণ আদালতও করতে পারে। আছে দেওয়ানি প্রতিকারের ব্যবস্থাও। এতোকিছু থাকার পরও খাদ্য আজ অনিরাপদ। সরকার চেষ্টা করছে। আদালত, ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছে। কিন্তু সচেতন না হলে কি এর থেকে মুক্তি আছে?

গৃহকর্তা চাকরকে ডাকছেন-
গৃহকর্তা: কিরে কেষ্টা কই গেলি?
চাকর: হুজুর আহার করছি।
গৃহকর্তা: বলিস কিরে বেটা। মহারানি ভিক্টোরিয়া করেন ভোজন, বড়লাট করেন আহার, আমি খাই, আর তুই তো গিলিস।

 
আমরা গিলছি। কিন্তু কী গিলছি?
 
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৪ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৮
এসএইচ/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।