১৮ জুন, ২০২০ তারিখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ের তথ্য মোতাবেক দেশে করোনা আক্রান্ত শনাক্ত এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সেই সাথে মৃতের সংখ্যাও প্রায় সাড়ে ১৩শ।
দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতিতে সামনের সারিতে থেকে লড়াই করে যাওয়া চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ, সিভিল প্রশাসন, সেনাবাহিনী, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ সকল ফ্রন্ট-লাইন যোদ্ধাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। সেই সাথে এই করোনাযুদ্ধে সম্মুখ সারিতে থেকে অত্যন্ত নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে বায়োটেকনোলজিস্টরা। কভিড-১৯ মোকাবেলায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বেছাসেবী হিসেবে এই ফ্রন্ট-লাইন বায়োটেকনোলজিস্টদের প্রতিও শ্রদ্ধা ও শুভকামনা জানাই। পাশাপাশি কভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায় এই বায়োটেকনোলজিস্টদের আরো সম্পৃক্ত করে একটি টেকসই স্বাস্থ্য খাত বিনির্মাণ করা সম্ভব বলে আশা রাখি।
কভিড-১৯ মোকাবেলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সর্বপ্রথম নির্দেশনা ছিল টেস্ট, টেস্ট ও টেস্ট। আর সেই টেস্ট টি মূলত RT-PCR (Real Time Polymerase Chain Reaction) পরীক্ষার মাধ্যমে করা হয়। এই পরীক্ষাটি একটি বিশেষায়িত পরীক্ষা যেখানে নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে ল্যাবরেটরি টেস্টের প্রায় প্রতিটি ধাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ধাপগুলো সম্পাদনের জন্য দক্ষ ও সঠিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সম্পন্ন লোকের প্রয়োজন।
জীববিজ্ঞান অনুষদভুক্ত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি এবং মাইক্রোবায়োলজি বিভাগসমূহে এই বিষয়গুলো তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক কোর্স হিসেবে পাঠ্য। ল্যাব টেস্টের জন্য উপযোগী বায়োসেফটি বিধান করা থেকে শুরু করে নমুনা সংগ্রহ, টেস্ট ও ফলাফল বিশ্লেষণ এমনকি ফলাফল প্রদানে উদ্ভূত যেকোন সমস্যার সমাধান বায়োটেকনোলজিস্টরা অত্যন্ত সুচারুরূপে করতে সক্ষম। কেননা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী গ্র্যাজুয়েটবৃন্দ RT-PCR পরীক্ষণের ধাপসমূহে তত্ত্বীয় ও প্রায়োগিক বিষয়ে অত্যন্ত পারদর্শী।
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব বায়োটেকনোলজি গ্র্যাজুয়েটস (বিএবিজি) এর তথ্যমতে, প্রায় পঞ্চাশের অধিক বায়োটেকনোলজিস্ট স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কভিড ল্যাব স্থাপন থেকে শুরু করে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষণে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছে। অনেকেই দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যন্য কভিড ল্যাবসমূহে টেস্ট এর প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেস রিলিজ থেকে জানা যায়, দেশের প্রায় ৬০টি কেন্দ্রে করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে যেখানে কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ নিজ ল্যাবেই নমুনা পরীক্ষণে সক্রিয়ভাবে অবদান রেখে চলছে। তাছাড়াও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল কিংবা গবেষণা কেন্দ্রে স্থাপিত কভিড ল্যাবগুলোতেও নমুনা পরীক্ষণে বায়োটেকনোলজিস্টরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান যেমন- জাতীয় জীবপ্রযুক্তি ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সমূহের জিনোম সিকোয়েন্সিং দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন বায়োটেকনোলজিস্টরা।
অপরপক্ষে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলীসহ গবেষণায় নিয়োজিত বৈজ্ঞানিকবৃন্দ সরাসরি করোনার নমুনা পরীক্ষণ, প্রশিক্ষণ প্রদান, ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স ছাড়াও দেশে করোনার গতি প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন।
করোনা পরিস্থিতিতে সামনে থেকে কাজ করে গেলেও হতাশার কথা হচ্ছে, অতি সম্প্রতি অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত মলিকুলার বায়োলজিস্ট পদে বায়োটেকনোলজিস্টদের বিবেচনায় আনা হয়নি। উপরন্তু, বেসরকারি মেডিকেল কলেজসমূহের কভিড টেস্টের জন্য প্রশিক্ষিত জনবলের সংজ্ঞায়নেও বায়োটেকনোলজিস্টদের রাখা হয়নি। উক্ত পদসমূহে বায়োটেকনোলজিস্টরা অত্যন্ত যোগ্য এবং গত তিন মাস ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তারা এর প্রমাণও রেখে এসেছেন। উক্ত পদসমূহে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদেরকে অবশ্যই বিবেচনায় এনে কাজের সুযোগ দেওয়া উচিত।
করোনা মহামারি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে যে সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাই উত্তরণের একমাত্র উপায়। সে নিমিত্তে প্রতিটি হাসপাতালে জাতীয় বেতন স্কেলের নবম গ্রেড পদমর্যাদার মলিকুলার বায়োলজিস্ট বা বায়োটেকনোলজিস্ট বা মেডিকেল সায়েন্টিফিক অফিসার নামে স্থায়ী পদ সৃষ্টি করে উক্তপদে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগসমূহ থেকে গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগ প্রদানে যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। এতে করে নিয়োগকৃত জনবলের কর্মযজ্ঞতায় দেশের প্রায় প্রতটি প্রান্তে জটিল সব ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা নির্ভুলভাবে সম্পাদন করা সম্ভবপর হবে। সেই সাথে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্থাপিত ল্যাবসমূহ সুষম ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরো টেকসই করবে।
রোগবালাই নির্মূল অথবা সংক্রমণক্ষম রোগের বিস্তার ঠেকাতে প্রতিষেধক আবিষ্কারের বিকল্প নাই। সে প্রেক্ষিতে প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণার জন্য জাতীয় প্রতিষেধক গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি সংশ্লিষ্ট গবেষকবৃন্দ বায়োইনফরমেটিক্স পদ্ধতিতে প্রতিষেধক সংক্রান্ত গবেষণা করছেন এবং তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। জিনোম সিকোয়েন্স গবেষণায় প্রাপ্ত উপাত্তসমূহকে কেন্দ্রীভূত গবেষণায় এনে প্রাপ্ত করোনা ভাইরাসের নমুনাসমূহের বিপরীতে প্রতিষেধক আবিষ্কারের পথে উপরোক্ত গবেষণা ফলাফলগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়াও ল্যাবরেটরি ভ্যালিডেশন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, মান নিয়ন্ত্রণসহ প্রতিষেধক উৎপাদনের সব পর্যায়ে বায়োটেকনোলজিস্টরা অবদান রাখতে পারবে।
গত বছর ডেঙ্গু ভাইরাস, কখনো নিপাহ ভাইরাস কিংবা ২০১৭ সালের চিকনগুনিয়া ভাইরাসের ভয়াবহ প্রকোপ দেখা গিয়েছিল। তাছাড়া পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই মহাবিশ্ব আরো অনেক অজানা ভাইরাসের সম্মুখীন হতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুধু করোনা মোকাবেলাই নয়, কাজের সুযোগ পেলে বায়োটেকনোলজিস্টরা অন্যান্য সক্রামক রোগসহ অন্যান্য জেনেটিক রোগের গবেষণায় নিয়োজিত থেকে দেশ ও জাতির কল্যাণে অবদান রাখতে পারবে। পাশাপাশি করোনা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মেডিকেল বায়োটেকনোলজিস্ট বা এনভায়রনমেন্টাল বায়োটেকনোলজিস্টদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। স্বাস্থ্য গবেষণায় প্রাধান্য দিয়ে ভবিষ্যতেও স্বাস্থ্য খাতে যেকোন ধরনের দুর্যোগের প্রতিবিধানেও বায়োটেকনোলজিস্টরা সচেষ্ট। এখনই সময়, দেশের বায়োটেকনোলজিস্টদের মেধা ও শ্রমকে দেশের কাজে যুক্ত করার।
এই অর্থবছরের বাজেটে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতকে যেখানে মোট বাজেটের প্রায় সাত শতাংশের বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। করোনা মোকাবেলা ও দেশের স্বাস্থ্য খাতে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে তের শতাংশ বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা সময়োপযোগী এবং সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। বিশাল অঙ্কের পরিচালন ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি শুধু স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে বারো হাজার কোটি যা এই খাতে বাজেটের প্রায় ৪৩ ভাগ। উক্ত বাজেটের সুষম ব্যবস্থাপনা করোনা মোকাবেলার পাশাপাশি একটি টেকসই স্বাস্থ্য খাত উপহার দিতে পারবে। উন্নয়ন ব্যয়ে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অন্যান্য বিষয়াদির সাথে সাথে স্বাস্থ্য গবেষণায় বরাদ্দ রাখা উচিত। করোনা মোকাবেলায় চিকিৎসক, নার্স ও মেডিকেল স্টাফদের সাথে কাজে লাগাতে হবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার ও বায়োটেকনোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলিজিস্ট ও বায়োকেমিস্টদের।
করোনা রোধে এ যুদ্ধ সবার। সমন্বিত এই উদ্যোগ স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী অবস্থানে উন্নীত করবে, যা একটি মাইলফলক হিসেবেই বিবেচিত হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: mmhasansohag@geb.jnu.ac.bd