করোনা মহামারি শুরুর সময় থেকে আইসিইউ শব্দটি আলোচনায় আসতে থাকে। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে আইসিইউ।
করোনারোগীর কমবেশি আশি শতাংশের তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। তাই তাদের কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। বাকি বিশ শতাংশের মধ্যে অধিকাংশের মৃদু ও মধ্যম লক্ষ্মণ দেখা দেয়। মোট শনাক্ত রোগীর তিন থেকে চার শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এদের মধ্যে আইসিইউ সেবা দিতে হয় অল্পসংখ্যক রোগীকে। প্রতিদিন কয়েক হাজার করোনা রোগী শনাক্ত হয়। সাধারণত এরা উপসর্গযুক্ত বিশ শতাংশের অন্তর্গত। দিনে পাঁচ হাজার রোগী শনাক্ত হলে তাদের মধ্যে কমবেশি একহাজার জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এভাবে এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সাত হাজারের মতো হয়ে যায়। দৈনিক শনাক্তকৃত রোগীর সংখ্যা সাত হাজারের বেশি হলে প্রতিদিন কত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়? একজন করোনাক্রান্ত রোগীকে ভর্তির পর হাসপাতালে সাধারণত দশ থেকে চৌদ্দদিন থাকতে হয়। জটিল রোগীর ক্ষেত্রে এই অবস্থানকাল আরো বেড়ে যায়।
দেশে আইসিইউ শয্যার সংখ্যা কমবেশি ১২৫০টির মতো। হাসপাতালে ভর্তি হাজার হাজার রোগীর মধ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করতে হলে ১২৫০টি শয্যা পূর্ণ হতে কয়দিন লাগে? মনে রাখতে হবে একজন রোগী গড়ে ১০ দিনের মতো আইসিইউতে অবস্থান করে।
বাংলাদেশে আইসিইউয়ের সংকট সবসময়ই ছিলো। তবে ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর এই সংকটের তীব্রতা সবাই বুঝতে পারে। তখন দায়িত্বশীলদের তরফ থেকে আইসিইউ সংকট সমাধানের কথা বারবার বলা হয়। অবশ্য অনেকের মনে আছে আজ থেকে সাতবছর আগে মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রতিটি জেলায় আইসিইউ স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দেশবাসী আশায় বুক বেঁধেছিল। বলাবাহুল্য সে আশা ফলবতী হয়নি।
২০২০ সালের ২৭ এপ্রিল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা প্রতিটি জেলার একটি ভালো হাসপাতালে একটি করে আইসিইউ স্থাপন করব। আমরা পর্যায়ক্রমে সকল জেলায় এটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
২০২০ সালের ২ জুন একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিটি জেলায় আইসিইউ স্থাপনের নির্দেশ প্রদান করেন। একনেকের সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের জানান, বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক জেলা সদর হাসপাতালে অবশ্যই একটা করে আইসিইউ স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত দেশের সব জেলায় আইসিইউ স্থাপন করা হয়নি।
গতবছরের এপ্রিল মাসে দেশের ৬৪টি জেলার ৪৭টিতে আইসিইউ ছিলো না। গত জুন মাসে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ বছরের এপ্রিল মাসে দেশের ৪২টি জেলায় আইসিইউ নেই। অর্থাৎ একবছরে পাঁচটি জেলায় আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছে। বাকি ৪২ জেলার আইসিইউ করার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কোথায় পাওয়া যাবে? প্রতিটি জেলায় দশ শয্যার আইসিইউ স্থাপন করতে আমাদের মোট ৪২০টি আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটরসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা ৪২০টি আইসিইউ দরকার।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে আমরা জেনেছি, গত দশমাসের অধিককাল যাবৎ ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের গোডাউনে ২০০টির মতো আইসিইউ সরঞ্জাম পড়ে রয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ কয়েকমাস ধরে কেন্দ্রীয় ঔষধ গুদাম সিএমএসডি-তে ২৭৮টির মতো আইসিইউ ইউনিট অলস ঘুমিয়ে আছে। আমাদের প্রয়োজন ৪২০টি ইউনিটের, দেশে আছে ৪৭৮টি আইসিইউ ইউনিট। মাসের পর মাস সেগুলো গুদামে পড়ে রয়েছে।
প্রতিদিন দেশে অনেক মানুষ একটি আইসিইউ শয্যার জন্য এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছে। গত তের মাসের বেশি সময়ে অনেক রোগী আইসিইউতে ভর্তি হতে না পেরে মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়েছে। অনেকে সরকারি হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হয়েছে। সেসব হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে গিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। হাসপাতালে রোগী বা মৃতদেহ রেখে স্বজনদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও অনেক ঘটেছে। কী অবস্থায় পড়লে মানুষ এরকম কাজ করে সেটা সবাই অনুভব করতে পারি। একজন মানুষের মৃত্যু একটি পরিবারের জন্য কতোটা গভীর দুর্যোগ নিয়ে আসে তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইসিইউ স্থাপনের সকল উপকরণ রয়েছে। অথচ সেগুলো মানুষের জীবন বাঁচাতে কোনো কাজে লাগানো হচ্ছে না। কী মর্মান্তিক ব্যর্থতা!
এইদেশে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন করা হয় না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়িত না হওয়ার জন্য কারা দায়ী? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। হাসপাতালের শয্যায় আইসিইউয়ের অপেক্ষায় থাকা মৃত্যুর প্রহর গোনা রোগী ও তাদের স্বজন, আইসিইউতে শয্যা না পেয়ে যারা প্রয়াত হয়েছেন তাদের প্রিয়জনসহ সকল দেশবাসী এই সরল প্রশ্নটির উত্তর জানতে চায়।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশ সময়: