অরিন্দম আকাশ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। স্ত্রী গৃহিণী।
শায়লা মেঘবানু ঢাকার একটি কিন্ডারগার্টেনে পড়াতেন। স্কুল বাধ্যতামূলক বন্ধ হয়ে গেলে সাড়ে চার বছরের ছেলেকে নিয়ে বাসায়ই অবস্থান করেন। ছেলেকে নিয়ে আগে স্কুলে গেলে সেখানে সে দৌড়াদৌড়ি করত, হেঁটে বেড়াত, খেলত। কিন্তু ঘরবন্দি হওয়ার পর থেকে ছেলেটির জীবনযাপন পুরো বদলে যায়। আগে মায়ের সঙ্গে ভোরে ঘুম থেকে উঠত। এখন ঘুমায় দেরি করে। অনেক বেলা করে ওঠে। ওঠার পর কান্নাকাটি করে। খেতে চায় না। গল্পও শুনতে চায় না। প্রথম দিকে টেলিভিশন ছেড়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করে কিছুটা সফল হলেও পরে মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ে। কিছুতেই ফোন তার হাত থেকে নেওয়া যায় না। এমনকি কোনো কোনো সময় টিভি রিমোটও তার দখলে রাখে। সারাক্ষণ বিরক্ত করে। খেলাধুলাও আর আগের মতো করতে চায় না। মাঝে মধ্যে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কাউকে দেখলে সে ছুটে এসে দরজা খুলতে চায়। বাইরে খেলতে ও ঘুরে বেড়াতে চায়।
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস এক আতঙ্কের নাম। তবে পৃথিবীব অন্যান্য দেশ ও অঞ্চল থেকে আমাদের দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার কম হলেও এ ভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে আমরা এখনো পুরোপুরি কেউ ঝুঁকিমুক্ত নই। এমনকি শিশুরাও। তাই পরিবারকে বিশেষ করে শিশুদের অধিকতর নিরাপদে রাখতে ঘরবন্দি রাখতে হচ্ছে গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত। আর এতে ব্যাহত হয়ে পড়ছে শিশুর স্বাভাবিক জীবনযাপন; বেড়ে ওঠাও।
শহুরে জীবনের প্রতিটি ঘরে শিশুসন্তান নিয়ে সবার সমস্যা প্রায় একই। গ্রামাঞ্চলের শিশুরা বাড়ির আঙিনায় খেলাধুলার সুযোগ পেলেও শহুরে শিশুদের এই করোনাকালে স্কুলে বা বাইরে যাওয়ার তাড়না না থাকায় বদলে গেছে জীবনযাপনের ধরন। দিন-রাত মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ কিংবা টেলিভিশন দেখে বেশি রাতে ঘুমানো এবং বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা; সর্বোপরি ঢিমেতালে জীবনযাপন, অলসতা মানবজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। ঘুম থেকে ওঠার পর হাতে বই ধরিয়ে দেওয়া, জোর করে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা, বকাঝকা অথবা কঠোর শাসনে রাখা; সর্বোপরি দীর্ঘদিন বন্ধু বা সঙ্গহীন থাকায় শিশুমনে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অথচ শিশুর বড় হওয়ার জন্য সুস্থ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ। চারপাশের পরিবেশ তাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। এর প্রতিফলন ঘটে তার ব্যক্তিত্বে। শিশুর মানসিক বিকাশে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা নিবিড়ভাবে জড়িত। একই সঙ্গে প্রয়োজন শিশুর সঙ্গে বাবা-মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলাও।
শিশুরা যে কোনো ধরনের মানসিক চাপে পড়লে তার প্রতিক্রিয়া দেখায় ভিন্নভাবে। তারা বাবা-মাকে আঁকড়ে ধরে, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, নিজেকে গুঁটিয়ে রাখে, রাগ করে, এমনকি অস্থিরও হয়ে ওঠে। শিশুর মানসিক চাপজনিত এ প্রতিক্রিয়াগুলোর প্রতি পরিবারের অন্যদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। পাশাপাশি শিশুর প্রতিটি কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে, আন্তরিকতার সঙ্গে শুনতে হবে। একটু বেশি ভালোবাসা দিয়ে রাখতে হবে এ সময়। বিরূপ পরিস্থিতিতে শিশুরা বড়োদের ভালোবাসা ও মনোযোগ একটু বেশিই প্রত্যাশা করে। এ সময় শিশুদের যতটা সম্ভব চাপমুক্ত রাখতে হবে এবং খেলাধুলার সুযোগ দিতে হবে। ব্যায়ামের অভ্যাস করাতে হবে। তাদের আচার-আচরণের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মোটকথা, শিশুর আবেগ, অনুভূতি এবং তাদের যে কোনো সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখাতে হবে।
শিশুদের দীর্ঘদিন ধরে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা নেই। বিদ্যালয়ে পড়া দিতে হয় না, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা নেই, খেলাধুলা, ঘোরাঘুরির আনন্দ থেকে বঞ্চিত তারা। অর্থাৎ জীবনের হঠাৎ এই ছন্দপতন তাদের মনে ও শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন তাদের জন্য আনন্দময় পরিবেশ। কারণ মনোবিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সময় শৈশব ও কৈশোর। এ সময় সবকিছু নতুনভাবে, নতুন আলোকে তাদের কাছে হাজির হয়। তাই প্রত্যেক শিশুর কাছে এ সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বেশিরভাগ শিশু যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। হাঁপিয়ে উঠেছে ঘরবন্দি থেকে। এ থেকে উত্তরণের পথ আঁকতে হবে বাবা-মাকেই। মনোবিদ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামালের মতে, ‘শিশুদের সঙ্গে যত বেশি সুন্দর সময় কাটানো যাবে, তাদের উদ্বেগ তত বেশি কমবে। পাশাপাশি তাদের জন্য বাসায়ই খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের হাতে তুলে দিতে হবে শিশুতোষ সাহিত্যের বই। ’
শিশুসাহিত্যিক এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত মাসিক শিশুর নির্বাহী সম্পাদক ফারুক নওয়াজ বলেন, ‘এই করোনাকালে শিশুকে হাসিখুশি ও আনন্দময় কাজের মধ্যে রাখা ছাড়া উপায় নেই। প্রথমত, শিশুর মন দিনভর চার দেয়ালের মধ্যে থাকতে চায় না। দ্বিতীয়ত, খেলাধুলায় কিছুটা সময় কাটাতে চায় তারা। চায় সঙ্গী। এ দুটি বিষয় বিবেচনায় এনে শিশুকে সম্ভব হলে ছাদে অথবা মুক্ত জায়গায় সকাল-বিকাল নিয়ে গিয়ে ঘোরা এবং তার খেলায় অংশী হতে হবে। শিশুর পড়াশোনা হতে হবে আনন্দের মধ্য দিয়ে। রঙিন ছবিওয়ালা ছড়া-গল্পের বই ওদের মন আকর্ষণ করে। যারা বর্ণ শেখেনি, পড়ে শোনাতে হবে তাদের। এতে তার ভালো সময় কাটবে, মেধারও বিকাশ ঘটবে। অবশ্য এ সময় শিশুর ব্যায়ামের প্রয়োজন। কারণ ঘরে থাকতে থাকতে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সেভাবে নড়াচড়া করা হয় না। এজন্য ওকে ঘরে ছোটাছুটি করার সুযোগ থাকতে হবে। বড়রা খেলাচ্ছলে তাকে ব্যায়াম শেখাতেও পারেন এবং করোনার নেতিবাচক বিষয় বা মৃত্যু আশঙ্কা ইত্যাদি নিয়ে কখনো শিশুর সামনে আলোচনা করা ঠিক হবে না। এতে শিশু আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠতে পারে। সোজাকথা, শিশুকে নেতিবাচক যাবতীয় আলাপের বাইরে রাখতে হবে। সবশেষে বলব, তার হাতমুখ ধোয়া নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। অন্তত খাওয়ার আগে ও পরে। তবে অতিরিক্ত হাতমুখ ধোয়ার অভ্যাস শিশুর নিয়মের মধ্যে না আনাই ভালো। এতে শিশু ভবিষ্যতে সুচিবাইগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। ’
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক এবং শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসাইন বলেন- ‘শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে সময় ও বয়স উপযোগী প্রতি দিনের রুটিন। নিজে খাবারের সময় শিশুকে সঙ্গে নিয়ে খাবার খাওয়া, গল্প-ছড়ার বই পড়া, টিভি দেখা, লুডু বা কেরাম খেলা, ব্যায়াম করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, গোসল করার মতো কাজগুলো করতে হবে। এ সময় শিশুদের নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী নামাজ বা প্রার্থনার অভ্যাস করা খুবই ভালো দিক হতে পারে। বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, যেমন- চিত্রাংকন, গান বা কবিতাচর্চা, ব্যায়াম বা শিশুর পছন্দ অনুযায়ী অন্য কিছু করানো ভালো। রাতে আবার পাঠ্যবই পড়া, শিশুদের শিক্ষামূলক কার্টুন দেখানো, ইতিহাস বা রহস্যকাহিনী শোনানো, ব্রাশ করানো, হাত ধোয়া, বিছানা তৈরি করা, মশারি টানানো, পানি খাওয়ার মতো অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে। এছাড়া নিয়মিত পাঠ সম্পূর্ণ করার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্য প্রাধান্য দিয়ে শিশুর খাদ্যাভ্যাস বা ইমিউন সিস্টেম ডেভেলপ করতে পরিবারের রাখতে হবে একটি সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্য পরিকল্পনা। ’
করোনামুক্ত দেশ গঠনে বাংলাদেশ সরকার অনেক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যে এসে গেছে করোনা প্রতিরোধক টিকা। ক্রমে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
শরীরের জন্য প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার। মস্তিষ্কের জন্যও তাই। মস্তিষ্কের পুষ্টিকর খাবার হচ্ছে সুচিন্তা। যান্ত্রিকজীবন, কর্মচাঞ্জল্যহীন জীবনযাপন অলস মস্তিষ্কের কারখানা। সৃজনশীল বা সুস্থ চিন্তা বাধাগ্রস্ত হয় তখন। ফলে আচরণ বদলে যায়। মানুষের সঙ্গে ব্যবহারও খারাপ হতে থাকে। শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ, আবেগগত ও বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশের জন্য তাই প্রয়োজন শিশুদের উপযোগী একটি সুষ্ঠু, সুন্দর, নির্মল ও প্রাণবন্ত পরিবেশ। আর তার ব্যবস্থা করতে পারেন প্রত্যেক বাবা-মা। তবেই শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা পাবে।
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও ছড়াকার
বাংলাদেশ সময়: ০০১৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০২১
নিউজ ডেস্ক