হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে মোট পাঁচটি সংসদীয় আসন। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে দেশজুড়ে।
রাজনৈতিক নেতাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রসঙ্গে সুনামগঞ্জ সদরের বাসিন্দা আরশেদ আলী বলছিলেন, ‘কুন সরকার আমরারে (আমাদের) পালন করে না। এটা নিয়ে ভাবতামও (ভাবি) না। আওয়ামী লীগ-বিএনপির ভেদাভেদ নাই। এই জেলায় একজন আরেকজনরে চেনে, সবাই মিল-মহব্বতে বসবাস করে। ’
জগন্নাথপুরের কেশবপুরের নান্নু মিয়া বলেন, ‘আমরা হাওরবাসী। সবসময় মিলেমিশে বসবাস করি। আমাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সাধারণ ঝামেলা হলে নিজেরাই মীমাংস করে ফেলি। আমাদের থানা-পুলিশের কাছে যাওয়া লাগে না। ’
মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে বিরোধী রাজনীতিককে আক্রমণ করলেও সুনামগঞ্জের নেতারা এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন না। তারা নিজের ইতিবাচক ভাবমূর্তি যেমন প্রচার করতে চান, তেমনি শ্রদ্ধা-সম্মান দেখান অপর দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী বা প্রার্থীকেও।
সুনামগঞ্জ-১ (ধর্মপাশা-জামালগঞ্জ-তাহিরপুর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক রণজিত সরকার। এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য নজির হোসেন ও ধর্মপাশা উপজেলা বিএনপি নেতা অধ্যাপক ডা. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী।
সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেন প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহধর্মিনী ও বর্তমান সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তা। এ আসনে ধানের শীষ প্রতীকের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক সংসদ সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরী।
সুনামগঞ্জ-৩ (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের ছেলে আজিজুস সামাদ ডন। এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরীও এ আসনে মনোনয়ন চান।
সুনামগঞ্জ-৪ (বিশ্বম্ভরপুর-সদর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে চান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মতিউর রহমান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন। বিএনপির মনোনয়ন চান সাবেক হুইপ ফজুলল হক আছপিয়া, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সম্পাদক নুরুল ইসলাম নুরুল ও জেলা যুবদলের সভাপতি আবুল মনসুর মোহাম্মদ শওকত।
আর সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক-দোয়ারাবাজার) আসনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন বর্তমান সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা শামীম আহমদ চৌধুরী। ধানের শীষের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সভাপতি কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন এবং শিল্পপতি ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ মুন্সিফ আলী প্রমুখ।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের সুনামগঞ্জের মানুষ নিরীহ। সবাই ক্ষেতে কাজ করে, মাছ ধরে ভাত খায়। আমাদের চাওয়া-পাওয়া খুবই কম। ’
শান্তিপূর্ণ ভোটে প্রার্থীদের ভূমিকা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এ মনোনয়নপ্রত্যাশী বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ ভোটে প্রার্থীদের অনেক ভূমিকা থাকে। অনেক সময় প্রার্থীর অনুসারী হয়ে থাকেন কর্মীরা। যেমন আমি নিজে মাস্তান নই, মাস্তানের ঠাঁইও আমাদের কাছে নেই। আমিও নিরীহ মানুষ, চলাফেরাও করি নিরীহ মানুষের সঙ্গে। ’
জেলা যুবদলের সভাপতি আবুল মনসুর মোহাম্মদ শওকত বলেন, ‘সুনামগঞ্জ ছোট একটা শহর। আমরা যে দলই করি না কেন, একে অপরের আত্মীয়ের মতো। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মিলেমিশে বসবাস। দেখা যায়, বিএনপির ঘরের মেয়ে আওয়ামী লীগ ঘরে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের ঘরের মেয়ে বিএনপির ঘরে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতার সময় আমরা আওয়ামী লীগকে ডিস্টার্ব করি নাই। একইভাবে আওয়ামী লীগও বিএনপিকে ডিস্টার্ব করে না। রাজনৈতিক হানাহানি আমাদের মধ্যে নেই, এটা দীর্ঘদিনের প্রথা। ’
আওয়ামী লীগের প্রতিমন্ত্রী মান্নানের প্রশংসা করে আবুল মনসুর বলেন, ‘মান্নান সাহেব (অর্থ-পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী) যতোই ভিন্ন দল করুন না কেন, তিনি অনেক ভালো মানুষ। অনেক কাজ করেছেন। তিনি সবাইকে ভালোবাসেন। ’
রাজনৈতিক এ সহাবস্থানে সন্তুষ্ট জেলার পুলিশ প্রশাসনও। সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার (এসপি) বরকত উল্লাহ খান বাংলানিউজকে বলেন, ‘সুনামগঞ্জবাসীর সুনাম অনেক। সবাই শান্তিপ্রিয়। পুরো জেলা হাওরের মধ্যে। এক থানা থেকে অন্য থানার দূরত্বও অনেক। সবাই একসঙ্গে পুলিশকে সহায়তা করে থাকে। একইভাবে নির্বাচনেও প্রার্থী এবং দলমত নির্বিশেষে সবাই আমাদের সহায়তা করে থাকে। ফলে আমরা শান্তিপূর্ণ ভোট উপহার দিতে পারি। ’
বাংলাদেশ সময়: ১০১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৮
এমআইএস/এইচএ/