কানাডার অটোয়া প্রবাসী লেখক ড. মীজান রহমান ৮২ বছর বয়সে গত ৫ জানুয়ারি পরলোক গমন করেন। বছরের শুরুতে আমরা হারালাম অতি আপনজনকে।
ইউএসপিএস এর মাধ্যমে একদিন নিউ্ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সপ্তাহিক প্রবাসী পত্রিকা অফিসে একটা খাম খুলে ড. জাফর ইকবালের লেখা চিঠির মাধ্যমে ড. মীজান রহমানের নামের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়। সম্ভবত ১৯৯৩ সালে। ড. জাফর ইকবাল তখন সাপ্ডেতাহিক ‘প্রবাসী’র উপদেষ্টা সম্পাদক। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ-এর নামে একটি চিঠিসহ ড. জাফর ইকবাল ‘প্রবাসী’তে প্রকাশ করার জন্য ড. মীজান রহমানের লেখাগুলো পাঠান। আমি তখন ‘প্রবাসী’র সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।
অত্যন্ত ছোট ছোট হরফে মীজান রহমানের পান্ডুলিপি দেখে আমি নিজেও একটু বিস্মিত হলাম! অনেকগুলো পান্ডুলিপি, একসাথে পাঠিয়েছিলেন প্রথমবার তিনি। পান্ডুলিপি প্রথম দেখার পর দুটো কারণে বেশী আগ্রহ জাগে আমার। প্রথমত ড. জাফর ইকবালের চিঠি সমেত প্রথম কোন লেখা আমি প্রবাসীতে (১৯৯১) কাজ করার পর থেকে প্রথম দেখতে পাওয়া। দ্বিতীয় লেখাগুলোর হরফ এত ছোট এবং এক শব্দের সাথে অন্য শব্দটি এত জড়ানো থাকতো তাঁর লেখায় যা বুঝা ছিল খুব কঠিন কাজ। তাই বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এখনো মনে আছে ড. জাফর ইকবাল চিঠিতে লিখেছিলেন গণিত বিভাগের একজন শিক্ষক কিভাবে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা খেরোপাতায় লিপিবদ্ধ করেছেন তা এককথায় অসাধারণ। তাঁর রচনাশৈলী যে প্রথাগত অন্যান্যদের লেখা থেকে পৃথক তা খুব অল্প সময়ের মধ্যে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘প্রবাসী’তে লেখা শুরুর কিছুদিন পরেই তিনি নিউইয়র্ক থেকে কৌশিক আহেমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক বাঙালি ও ঢাকায় দৈনিক জনকন্ঠ-তে লেখা শুরু করলেন।
বাংলাদেশের পাঠকও জানা শুরু করলেন অটোয়া প্রবাসী গনিত বিভাগের একজন শিক্ষকের কলম থেকে ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে কি সব অসাধারণ লেখা। তখন ‘প্রবাসী’তে লেখালেখি-সম্পাদনা করার পাাশাপাশি আমাকে অনেক লেখকের লেখা টাইপও করতে হতো। সে থেকে মীজান রহমানের পান্ডুলিপি পেলে আমি নিজের আগ্রহেই টাইপ করতে নিতাম, যাতে করে লেখাটি প্রকাশ হওয়ার আগে আমার পড়ার সুযোগ হয় সেজন্য।
১৯৯৪ সালে যখন মন্ট্রিয়ল প্রবাসী আলম খোরশেদ মীজান রহমানের ‘তীর্থ আমার গ্রাম’ প্রকাশ করেন তখন অধীর আগ্রহে বইটা পাঠ করলাম বললে ভুল হবে, গোগ্রাসে গিললাম। এত আনন্দ পাই সে বইটি পাঠ করে যা বলার মত নয়। আমার জীবনে ভাল লাগা বইয়ের মধ্যে এটিও প্রথমদিকে থাকবে। ১৯৯১ সালে মুক্তধারা নিউইয়র্ক গঠিত হবার পর থেকে আমি উডসাইডের বাসায় সেলফ করে বাংলা বই বিপণন শুরু করি। ১৯৯২ সালে শুরু হয় জাতিসংঘের সামনে শহীদ মীনার স্থাপন করে একুশের শহীদদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এবং উত্তর আমেরিকায় বাংলা বই মেলার গোড়াপত্তন।
গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার পরের বছর ১৯৯৫ সালে মীজান রহমান লোক মারফত আমাকে তাঁর তীর্থ আমার গ্রাম বইটা পাঠালেন বইমেলায় প্রদর্শনীর জন্য। তারপর ১৯৯৭ সালে জ্যাকসন হাইটসে মুক্তধারার বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার তাঁর সাথে যোগাযোগটা আরো বেড়ে যায়। ২০০১ সালে আমাদের আমাদের বন্ধু প্রকাশক সন্দেশ প্রকাশনার প্রধান এবং এক সময় ‘বিনিময়’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক লুৎফুর রহমান চৌধুরী মীজান রহমানের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘লাল নদী’ প্রকাশ করেন। লুৎফুর- হলো আমার জীবনের লেখা প্রথম গল্প ‘রেশমী চুড়ি’র প্রকাশের সম্পাদক। স্বাভাবিক কারণেই তার প্রতি আমার একধরনের টান ছিল।
তাছাড়া থিয়েটার এর এক সময়ের দপ্তর সম্পাদক শেখ আজম এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল লুৎফুর। ৪৪ আরামবাগে থিয়েটার এর যে অফিস ছিল, সে বাড়িতেই লুৎফুর-এর সাথে প্রথম পরিচয়। সে সুবাদেই মীজান রহমানের বইটি প্রকাশের জন্য লুৎফুর এর সাথে দ্রুত যোগাযোগ ঘটে। ২০০৯ সালে নিউইয়র্কে মুক্তধারার আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলায় মীজান রহমানকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয় মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে। সেটিই আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে।
মনে পড়ছে নিউইয়কের উদীচি কর্তৃক তাঁর জন্মদিন পালন করার কথা। অ্যালবাম, প্রসঙ্গ নারী, অনন্যা আমার দেশ, আনন্দ নিকেতন, দুর্যোাগের ইতিহাস, শুধু মাটি নয়, ভাবনার আত্মকথা এবং সর্বশেষ শূণ্য গ্রন্থসহ মোট ১০টি গ্রন্থ লিখে গেছেন। আমাদের জন্য রেখে গেছেন অমূল্য রত্নরাজি। ১৯৩২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
১৯৬৫ সালে অটোয়ার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেয়া মানুষটি ২৫ বছর পর শুরু করেছিলেন বাংলায় লেখালেখি। তাঁর জীবনের অনেক ঘটনা ব্যথা-বেদনা-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সবই ফুটিয়ে তোলেন তাঁর ছোট ছোট কথায়। সেটিই আজ বেশী মনে পড়ছে। গনিত বিভাগে গবেষণার জন্য অনেক বড় পুরস্কার তিনি পয়েছেন ঠিকই কিন্তু বাংলা ভাষায় লেখালেখির জন্যই তিনি বাঙালির হৃদয়ে চির জাগরুক হয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৫