ঢাকা, শনিবার, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২, ১২ জুলাই ২০২৫, ১৭ মহররম ১৪৪৭

সারাদেশ

জুলাইগাথা

শহীদ ছেলের কবরপানে চেয়ে দিন কাটে মায়ের

মোমেনুর রশিদ সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:১৯, জুলাই ১১, ২০২৫
শহীদ ছেলের কবরপানে চেয়ে দিন কাটে মায়ের ছেলের কবরপানে চেয়ে বসে থাকতে দেখা যায় শহীদ শাকিনুরের মা অফিজা বেগমকে। ছবি: বাংলানিউজ

গাইবান্ধা: প্রকৃতিঘেরা পরিবেশ। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে করতোয়া নদী।

তীরে বসে সুঁই-সুতা হাতে নকশিকাঁথা সেলাই করছেন
মাঝ বয়সী এক নারী। মাঝে-মাঝে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকাচ্ছিলেন নদীর ওপারে। সেখানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত আছেন তার বুকের ধন জুলাই যোদ্ধা শাকিনুর রহমান।  

বুধবার (৯ জুলাই) দুপুরে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের কিশোরগাড়ী সুলতানপুর বালুপাড়ায় গিয়ে এভাবেই বসে থাকতে দেখা যায় শাকিনুরের মা অফিজা বেগমকে।

কাছে গিয়ে কথা বলতেই যেন দেহে প্রাণ ফিরে পান তিনি। ছেলের কথা বলতেই চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরতে থাকে তার।

চোখ মুছতে-মুছতে ছেলের স্মৃতিচারণ করে অফিজা বেগম বলেন, ছেলেকে হারানোর এক বছর হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে মন টেকে না।  

কাজের ছলে বাড়ির সামনে নদীর তীরে বসে-দাঁড়িয়ে শাকিনুরের কবরের দিকে চেয়ে শান্তি খোঁজেন তিনি।  

কখনো শাকিনুরের শোবার ঘর-বিছানায় বসে-শুয়ে স্মৃতি হাতড়ান। ছেলের ছবি বুকে নিয়ে সময় কাটান। ছেলের কাপড়-চোপড় স্পর্শ করে
কেঁদে মন হালকা করেন তিনি।

একই অবস্থা শাকিনুরের ছোট্ট বোন জামিলার। স্থানীয় টোংরারদহ নুরানি মাদরাসায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ে শিশুটি। সে বিশ্বাস করে না যে শাকিনুর মারা গেছেন। তিনি আর কখনো ফিরে আসবেন না। ভাই ফেরার অপেক্ষা আজও দিন গুণছে শিশুটি।

শাকিনুরের মা বলেন, জামিলাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় ঈদ এলে। সে কারো দেওয়া জামা পছন্দ করে না। শুধু বলে শাকিনুর ভাই আমার জন্য ঈদের জামা নিয়ে আসবে।  

ছেলেকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন সম্পর্কে তিনি বলেন, শাকিনুরকে ঘিরেই তাদের সব আশা ছিল। ছেলে নিয়মিত ফোন দিত, বাবা-মায়ের খোঁজ খবর নিত। ভাই-বোনদের লেখা-পড়ার খরচসহ বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করত। আজ ছেলেকে হারিয়ে সব ভার এসেছে পড়েছে নিজেদের কাঁধে।  

কৃষক বাবা জালিম মিয়া বলেন, পরিবারের অর্থিক অনটনের কারণে স্ত্রী শারমিন ও কোলের শিশু সন্তান সহিবকে নিয়ে জীবিকার উদ্দ্যশ্যে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিল শাকিনুর। সেখানে আশুলিয়া থানার ভাদাইল এলাকায় ভাড়া বাসায় থেকে গার্মেন্টসে কাজ করত শাকিনুর। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ। বাদ যায় না সাভার আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলও। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন ঢাকার আশুলিয়া বাইপাইল এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেখানে শাকিনুরও আন্দোলনে অংশ নেয়। ওই সময় আন্দোলন দমাতে পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছুড়তে থাকে। পুলিশের একটি গুলি শাকিনুরের পিঠ ভেদ করে বুক দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই শাকিনুরের মৃত্যু হয়।  

তিনি আরও বলেন, শাকিনুর ছিল তিন ছেলের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় ছেলে শাহ কামাল মানসিক ভারসাম্যহীন, ছোট ছেলে শাহ জামাল পড়াশোনা করছে। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে, ছোটটি মাদরাসায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। শাকিনুরের মৃত্যুর পর মেয়েকে নিয়ে তার স্ত্রী বাবার বাড়িতে থাকে।  

সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার বিষয়ে জালিম মিয়ার দাবি, এ পর্যন্ত তারা ১৩ লক্ষাধিক টাকা অনুদান পেয়েছে শাকিনুরের পরিবার। এর মধ্যে যে গার্মেন্টসে শাকিনুর কাজ করতেন, সেখান থেকে দুই লাখ, একটি ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ, গাইবান্ধা জেলা পরিষদ থেকে দুই লাখ, রংপুর শিল্পকলা একাডেমি থেকে পাঁচ লাখ এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে পেয়েছেন তিন লাখ টাকা। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে এককালীন ৩০ লাখ টাকা দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

তিনি আরও দাবি করেন, ১৩ লক্ষাধিক টাকার মধ্যে তিনি পেয়েছেন এক লাখ টাকা। বাকি টাকা পেয়েছেন শাকিনুরের স্ত্রী। আর যে ৩০ লাখ টাকা পাওয়ার কথা, তার থেকে শাকিনুরের স্ত্রী-সন্তানের পাশাপাশি বাবা-মাকেও একটি অংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।