ঢাকা, রবিবার, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২, ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৭ মহররম ১৪৪৭

সারাদেশ

জুলাইগাথা

নয় মাসে বাবা ডাকা শিখলেও সাড়া দেওয়ার কেউ নেই মুসআবের

ইমতিয়াজ আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৩২, জুলাই ১২, ২০২৫
নয় মাসে বাবা ডাকা শিখলেও সাড়া দেওয়ার কেউ নেই মুসআবের স্ত্রী ও সন্তান এবং মনির

নয় মাস বয়সী শিশু মুসআব ইবনে মনির। জুলাই আন্দোলনে শহীদ হওয়া মাদারীপুরের মনিরুজ্জামান মনিরের সন্তান।

নয় মাসে মুখে বাবা ডাক ফুটলেও সে ডাকে সাড়া দেওয়ার কেউ নেই শিশুটির! সাড়া দেবেও না কোনোদিন। বাবার আদর ছাড়াই বড় হয়ে উঠবে শিশু মুসআব।  

শিশুটির মা সামিরা ইসলাম মনে করেন, বড় হয়ে তার সন্তান মুসআব বাবার আত্মত্যাগের গল্প শুনবে। বাবাকে নিয়ে গর্বে বুক ভরে উঠবে ওর। বাবার আত্মত্যাগের গল্প বলে বেড়াবে অন্যদের কাছে!

মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার শাখেরপাড় এলাকার নুরুল ইসলাম মোল্লার ছেলে মনিরুজ্জামান মনির। ঢাকার একটি জুতার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। পাশাপাশি লেখাপড়াও করতেন একটি কলেজে। ৫ আগস্ট আন্দোলনে গিয়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া এলাকায় পুলিশের গুলিতে মারা যায় মনির। তখন তার স্ত্রী সামিরা আক্তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী মারা যাওয়ার তিন মাসের মাথায় পুত্র সন্তানের জন্য হয়। ভাঙা ভাঙা শব্দে বাবা ডাকতে পারলেও শিশুটির এই ডাক কখনও পৌঁছাবে না বাবার কানে! অবুঝ শিশুটিও জানে না তার বাবা নেই, আসবে না কোনোদিন!

স্ত্রী সামিরা ইসলাম বলেন, প্রথম সন্তান আসবে পৃথিবীতে। ওর বাবার কত স্বপ্ন ছিল। সন্তানের মুখ দেখার জন্য ব্যকুল হয়ে থাকতো।

জানা গেছে, রাজৈরের মনিরুজ্জামান মোল্যা মনির ঢাকার একটি জুতার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন মনির। গত বছরের ৫ আগস্ট সকালে মনিরুজ্জামান মোল্যা মনির তার এক বন্ধু কাজী আলমকে সঙ্গে নিয়ে ছাত্র-জনতার ডাকা গণমিছিলে যোগ দেন। সন্ধ্যার দিকে মাদারীপুরে ফেরার পথে পুলিশ সদর দপ্তর সংলগ্ন ফুলবাড়িয়া এলাকার একটি মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে এসে দেখেন পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে গোলাগুলি হচ্ছে। দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন মনির। পড়ে যান রাস্তায়।  

পরে গুরুতর অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মনির।  

এদিকে মনিরের পরিবার তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ায়, খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। পরে তারা ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় জানতে পারেন বিজয় মিছিলে মনির গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে আছে। পরে ওইদিন রাতেই মনিরের লাশ নিজ বাড়িতে আনা হয়। পরের দিন ৭ আগস্ট সকালে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মারা যাওয়ার তিন বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেন মাদারীপুর সদর উপজেলার মধ্যখাগদী এলাকার জলিল সরদারের মেয়ে সামিরা ইসলামকে। পরে মাদারীপুরের নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন মনির। তার উপার্জনের টাকা দিয়েই চলতো স্ত্রীসহ তার মা, বাবা, এক বোন ও তার সন্তানদের খরচ। এসময় তার স্ত্রী ছিলেন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মনির মারা যাওয়ার তিন মাস পর ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর জন্ম নেয় তার ছেলে।  

বর্তমানে সামিরা তার সন্তানকে নিয়ে শহরের বাগেরপাড় এলাকায় তার বোনের বাসায় ভাড়া থাকেন। মনিরের শেষ স্মৃতি আদরের সন্তানকে নিয়ে সারাজীবন থাকতে চান সামিরা। সরকারি-বেসরকারি সব মিলিয়ে কমপক্ষে ১৬ লাখ টাকা পেয়েছেন নিহত মনিরের স্ত্রী। এছাড়াও ঈদ সামগ্রীসহ নানা অনুদানও পেয়েছেন। অনুদানের টাকা ব্যাংকে রেখে তাতেই শিশুসন্তান নিয়ে দিন কাটছে তার।

নিহতের স্ত্রী সামিরা ইসলাম বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন মনির। সেই মিছিলে গুলিতে মারা যান। তখন আমি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। আমার আর মনিরের অনেক স্বপ্ন ছিল সন্তানকে নিয়ে। কিন্তু আমার সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই তার বাবা পৃথিবী থেকে চলে গেল। এখন আমি এই সন্তানকে নিয়েই বেঁচে আছি। '

নিহত মনিরের বোন নুসরাত জাহান ডালিয়া বলেন, 'আমার এই ভাইটি ছিল আমাদের সংসারের উপার্জনকারী। তার উপার্জনেই সংসার চলতো। সেই ভাই এর একমাত্র সন্তান আজ এতিম হয়ে বেড়ে উঠছে। আমার ভাই এর অনেক স্বপ্ন ছিল তার সন্তানকে নিয়ে। কিন্তু আমার ভাই বাবা ডাক শুনতে পেল না, সন্তানের মুখটিও দেখতে পেল না। এই কষ্ট আমাদের সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে!'

নিহতের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার সন্তানকে হারিয়েছি। আরও কতশ মা তার সন্তান হারিয়েছে এই জুলাই বিপ্লবে। আমার নাতি তার  বাবাকে পেল না! বাবার স্মৃতি নিয়েই তাকে বড় হতে হবে। এই নাতির মধ্যেই আমরা মনিরকে খোঁজার চেষ্টা করি!'

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, আমরা যেকোনো প্রয়োজনে ওই শিশুটির পাশে থাকবো। সাধ্যমত সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।

আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।