পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে লেখাপড়া এগিয়ে নিতে পারেননি শরীয়তপুরের রিয়াজুল তালুকদার (৩৬)। কিশোর বয়সেই স্থানীয় বাজারে সাইকেল মেরামতের কাজ শিখতে হয় তাকে।
সংসারে অর্থকষ্ট থাকায় দ্রুত আয়ের পথ খুঁজতে থাকেন রিয়াজুল। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ঢাকায় গিয়ে গুলিস্তানের স্পোর্টস মার্কেট এলাকায় মালবাহী ভ্যান চালানোর কাজ শুরু করেন। বিয়েও করেন। ২০১৮ সালে পারিবারিকভাবে তার বিয়ে হয় শিমু আক্তারের সঙ্গে। দুজনের সংসার আলো করে আসে তাদের দুই সন্তান মেহজাবিন (৫) ও মোস্তাকিম আহমেদ হীরা (৩)। কিন্তু দীর্ঘদিনের পারিবারিক কলহের জেরে বিচ্ছেদ ঘটে এই দম্পতির। শিমু আক্তার বিচ্ছেদের পর সন্তানদের রেখে চলে যান। রিয়াজেুলের দুই সন্তানের দায়িত্ব এসে পড়ে দাদা-দাদির কাঁধে।
২০২৪ সালের জুলাই মাস। রাজধানী ঢাকায় শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান, ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশেও। আন্দোলনের সেই উত্তাল পরিস্থিতিতে ৪ আগস্ট দুপুরে গুলিস্তান থেকে চিটাগং রোডে পণ্য সামগ্রী নিতে যাওয়ার পথে রিয়াজুল গুলিবিদ্ধ হন। ফ্যাসিস্ট সরকারের তাবেদারদের গুলি লাগে রিয়াজুলের কোমরে। আশপাশে থাকা আন্দোলনকারীরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার দিকে তার পরিবারকে কল করে জানানো হয়, ‘রিয়াজুল গুলিবিদ্ধ, দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। ’
খবর পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রিয়াজুলের ভাই রাসেল তালুকদার হাসপাতালে ছুটে যান। সঙ্গে ছিলেন তাদের আরেক ভাই নাহিদ। ঢাকায় পৌঁছে তারা শুনতে পান, রিয়াজুল আর বেঁচে নেই। ৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন রিয়াজুল।
শহীদ ভাইয়ের লাশ পরিবারের কাছে নিয়ে যেতে প্রক্রিয়া শুরু করেন রাসেল। কিন্তু প্রতি পদে পদে তাকে ও নাহিদকে ভোগান্তি পোহাতে হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের জানায়, লাশ নিতে হলে থানার লিখিত অনুমতি আনতে হবে। রাসেল তালুকদার প্রথমে যান শাহবাগ থানায়। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় যাত্রাবাড়ি থানায়। কিন্তু যাত্রাবাড়ি থানা তাকে ফেরত পাঠানো হয় শাহবাগে। দুই থানার সাত-আটবার দৌড়ঝাঁপ করেও কোনো ছাড়পত্র পাননি রাসেল। এভাবেই ৪ আগস্টের প্রতিটি মুহূর্ত কেটে যায়।
পরদিন ৫ আগস্ট দুপুরের দিকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ও শেখ হাসিনার পতন হয়। তার আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) এলাকার বিক্ষোভ চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। ছাত্র-জনতা এতটাই বিক্ষুব্ধ ছিল যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের তালা ভেঙে ফেলে।
রাসেল তালুকদার বলেন, ৪ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে রিয়াজুলের ফোন থেকে একজন কল করে জানান যে তার গুলি লেগেছে। আমাদের দ্রুত ঢামেকে যেতে বলা হয়। খবর পাওয়া মাত্র নাহিদকে নিয়ে আমি ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে শুনতে পাই রিয়াজুল মারা গেছে। ৪ তারিখ রাত ৭টা ৪০ মিনিটে আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর হাসপাতাল থেকে আমাদের জানানো হয়, থানা থেকে লিখিত আনতে হবে নইলে মরদেহ দেবে না। এরপর আমি শাহবাগ থানায় গেলে সেখান থেকে আমাকে পাঠানো হয় যাত্রাবাড়ি থানায়। কিন্তু যাত্রাবাড়ি থানা থেকে আমাকে শাহবাগ থানায় ফেরত পাঠানো হয়। এভাবে একটি কাগজের জন্য আমি দুই থানায় ৭ থেকে ৮ বার ঘোরাঘুরি করি। কিন্তু কোনো থানা থেকেই কাগজ পাইনি।
রাসেলের দাবি, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে হাসপাতালের মর্গের রুম ভাঙে ছাত্ররা। তিনি বলেন, এরপর আমি আমার ভাইয়ের মরদেহ পুলিশের ছাড়পত্র ছাড়া শুধু হাসপাতালের ছাড়পত্র দিয়ে নিয়ে এসে গ্রামের বাড়িতে দাফন করি। রুবেল তালুকদার রিয়াজুলের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকায় মামলা দায়ের করেছেন বলেও জানান।
রিয়াজুলের কথা স্মরণ করে কেঁদে ওঠেন তার মা শেহেরজান। বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি জানান, আন্দোলন শুরু হওয়ার মাত্র দুই মাস আগে রিয়াজুলের সঙ্গে তার স্ত্রী শিমু আক্তারের বিচ্ছেদ হয়। তাদের দুই সন্তান মেহজাবিন ও মোস্তাকিমের দায়িত্ব নিতে হয় তাকে। এখন তার ছেলেও শহীদ। তিনি অসুস্থ, প্রতি মাসে তার অনেক টাকার ওষুধ লাগে। সব টাকা রিয়াজুল দিতেন। শেহেরজান আশঙ্কা করেন, তিনি অসুস্থ হলে বাপ-মা হারানো তার নাতি-নাতনিদের দেখবে কে?
জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকার থেকে ১০ লাখ টাকা পেয়েছে শহীদ রিয়াজুলের পরিবার। এছাড়া একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ৫ লাখ টাকা পেয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকেও তাদের সহায়তা করা হয়েছে।
শেহেরজানের ভাষ্য, টাকা দিয়ে তো আর সন্তান ফেরত পাওয়া যায় না। এতিম বাচ্চারা তাদের বাবাকে ফেরত পাবে না। তার একার পক্ষে মেহজাবিন ও মোস্তাকিমের দায়িত্ব পালন ও ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা অসম্ভব। তাদের জমিজমা কিছু নেই। না খেয়ে থাকলেও কেউ দেখতে আসে না। তিনি বলেন, এই দুইটা পোলাপান কী কইরা মানুষ হইব? আমরা সন্তান হত্যার বিচার চাই।
রিয়াজুলের মেয়ে মেহেজাবিনের সঙ্গেও কথা বলেছে বাংলানিউজ। কিছুই না বোঝা ছোট্ট মেহেজাবিন ছোট ছোট শব্দে বলে, জুলাই মাসের আন্দোলনে আমার বাবারে গুলি করে মেরে ফেলছে। এখন নতুন জামাকাপড়-জুতা নিয়ে বাবা আসে না। বাবাকে যারা মারছে তাদের বিচার চাই।
শহীদ রিয়াজুলের বিষয়ে কথা হলে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক তাহসিনা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, জুলাই যোদ্ধা ও শহীদদের পাশে সরকার সবসময় ছিল ও থাকবে।
এমজে